হাওরে অন্যরকম লড়াই

‘কোনো কাজ নেই। ঘরেও মন বসে না। তাই পচা ধান কাটতে আইছি।’ হাওর তীরবর্তী অংশের ডুবে থাকা আধপাকা পচা ধানেই এখন এমন স্বপ্ন চাষিদের। জেলার হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওরের সর্বস্বান্ত কৃষক এখন পচা ধান সংগ্রহে ব্যস্ত। এ বছর হঠাৎ চৈত্রের আগাম বন্যায় পানিতে তলিয়ে যাওয়া থোড় হওয়া বোরো ধান একেবারেই নষ্ট হলেও কিছুটা ধান মিলছে আধপাকা অবস্থায় ডুবে যাওয়া বোরো ধান গাছ থেকে। ক’দিন থেকে পানি কমেছে। এতে অগ্রভাগ ভেসে উঠেছে মরা পচা বোরো ধানের। এ অবস্থায় হাওর পাড়ের সর্বস্বান্ত কর্মহীন চাষিরা ঘরে বসে অলস সময় কাটাতে চান না। নেশার টানে এখন তারা ছুটছেন ওই ধান সংগ্রহ করতে। কর্মচঞ্চল কৃষকরা নৌকাযোগে বুক পানি কিংবা কোমর পানি থেকে সংগ্রহ করছেন ধান। সারা দিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে আনা ধান মাড়াই ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে প্রাপ্ত ধান দেখে শুধুই দুই চোখের জল ফেলছেন। নৌকায় বোঝাই করা সংগৃহীত ধানে সব প্রক্রিয়া শেষে হচ্ছে ৮ কিংবা ১০ কেজি। যেখানে বন্যায় ক্ষতি না হলে মিলতো ১২০-১৩০ কেজি ধান। তারপরও ঘরে না বসে ডুবে থাকা পচে যাওয়া বোরো ধান সংগ্রহে ব্যস্ত হাওর তীরের কয়েকটি এলাকার চাষিরা। মনসান্ত্বনা এমন করে যদি কিছু ধানও ঘরে তুলতে পারেন তাহলে ‘ঊনা উপাস’ থাকার ছেয়ে দুই মুঠো ভাত পরিবার পরিজনের মুখে দিতে পারবেন। স্বপ্নের বোরো ফসলের নেশা তাদের টেনে নিচ্ছে হাওরে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পচে ধান গাছে যেমন দুর্গন্ধ, তেমনি ধানেও। কৃষকরা জানালেন, স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে তারা জেনেছেন ওই পচা বোরো ধান সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে বা সিদ্ধ করে শুকিয়ে ওই চাল থেকে ভাত তৈরি করে খেলে কোনো সমস্যা হবে না। ওই চালের গুনগত মানও নষ্ট হবে না। এরপর থেকে হাওরের তীরবর্তী অংশের যে আধপাকা ধান বানের পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল তা কিছুটা ভেসে উঠায় এখন তা সংগ্রহ করছেন চাষিরা। এশিয়ার বৃহত্তম  হাকালুকি হাওর ও কাউয়াদিঘি আর হাইলহাওরে অকাল বন্যার এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাওরের শতভাগ বোরো ধান। এক মাস পরও যদি কিছু ধান পাওয়া যায় এই আশায় পচা ধান সংগ্রহে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চলছে হাওর তীরের কৃষকের। গতকাল সরজমিন হাকালুকি হাওরের বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া অংশে এমন দৃশ্য দেখা গেল। হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া ভুকশিমইল ইউনিয়নের মদনগরীর বশির উদ্দিন (৫০), কুরবানপুরের আবদুল মান্নান (৬৫), উত্তর সাদিপুরের জালাল মিয়া (৪৬), বারিক মিয়া (৬৮), ফারুক মিয়া (৬৪), আতির আলী (৬৬) জানালেন, আধপাকা অবস্থায় যে ধান পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল তা কিছুটা ভেসে উঠায় এখন সংগ্রহ করছেন তারা। কিন্তু সারা দিন পরিশ্রম করে যে ধান পান তা দিয়ে মন ভরে না। তারপরও যদি কিছু ধান সংগৃহীত হয় এমন আশায় তারা এখন পচা ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। জুড়ীর জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের বাচ্চু মিয়া (৩৮), মানিক মিয়া (৪৫), দলা মিয়া (৫০), রুমি বেগম (২৪), সুলতানা বেগম (৪০), বানেছা বেগম (৪৮) জানান, তলিয়ে যাওয়া ধান জেগে ওঠায় আশা ছিল কিছু যদি পাই। নিজে এবং মানুষ দিয়ে পেড়া (পচা) ধান দাওয়াইয়া (কাটিয়ে) তুলছিলাম (তুলেছি)। কিন্তু শতকরা দশটা ধানও ভালো নেই। তাদের মতো অনেকেই রাস্তার ওপর ধান মাড়াই ও পরিষ্কার করতে করতে বললেন, ধান নেই। কি খাবো সারা বছর? ছেলে সন্তান নিয়ে কি উপোস থাকব। কেঁদে কেঁদে তাদের এমন দুশ্চিন্তার কথা বলেন। চাষিরা জানান, নৌকা দিয়ে পানির নিচ থেকে ধান তুলে এনে প্রথমে রোদে শুকান। তারপর মাড়াই দিয়ে ঝেড়ে যদি কিছু ধান পাওয়া যায় এই আশায় তারা এখন প্রতিদিনই পরিশ্রম করছেন।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর