নতুন রেকর্ডে ঘুরছে কৃষির চাকা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে দেশের কৃষি খাত। ফসল উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাইলফলক। বর্তমান সরকারের সুপ্রসারিত কৃষিনীতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্যিক কৃষি উন্নয়ন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং উন্নয়নসহ কৃষির আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানামুখী পদক্ষেপের কারণে কৃষিতে ঘটছে নীরব বিপ্লব।

বর্তমান সরকারের বহুমুখী পরিকল্পনা ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে চাল উৎপাদন বর্তমানে ৩৩৮ দশমিক ১৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৯ বছরে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫ গুণ। শাকসবজি উৎপদানে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের তৃতীয় যা চীন-ভারতের পরেই রয়েছে এবং প্রাণিসম্পদ বিশেষত পোলট্রি শিল্প দেশে গার্মেন্টের পরই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে বিবেচিত।

দেশের কৃষি ও মৎস্য শিল্প নিয়ে গবেষণা ও নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার অধিক গুরত্ব দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশেই কৃষি বিজ্ঞানীদের পাটের ওপর গবেষণা ও এ ফসলের জীবন রহস্য উদ্ভাবন বিশ্বের এক যুগান্তকারী ঘটনা। আবার সম্প্রতি মৎস্য বিজ্ঞানীরা ইলিশের ওপর এ প্রজাতির জীবন রহস্য উদ্ভাবন আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা।

এদিকে, ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং তার প্রজনন, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদিতে সরকার যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে বাংলাদেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীব্যাপী কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তিতে দেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন জৈব কৃষি ও তার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের পথে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিন বা জিনগুলোকে আবিষ্কার করে তা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের জিনোমে ঢুকিয়ে নতুন ক্ষমতা সম্পন্ন ফসল উদ্ভিদ তৈরি করে চলছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ধান, গম, আলুসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য খাতেই বইছে উন্নয়নের জোয়ার। বর্তমানে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি। বছরে আলু উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ২ লাখ মেট্রিক টন। প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। শুধু উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যই নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। গত বছর আলু রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের।

মৎস্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছরে চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। ভিটামিনখ্যাত শাক-সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৩২ লাখ ৯৭ হাজার মেট্রিক টন। তেল, ডাল ও মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৫০ হাজার, ২ লাখ ৪ হাজার ও ১ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। ভুট্টার ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণের বেশি। শুধু দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোই নয়, বিদেশে রফতানির লক্ষ্য নিয়ে কৃষি খাতের উন্নয়ন এগিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার, ১৪২৩ -এর বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষি আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। ধান, মাছ, মাংস, আম, পেয়ারা ও ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ করায় কৃষিতে আধুনিকায়ন ঘটেছে। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে কৃষিতে বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ, দফায় দফায় সারের দাম কমানো, কৃষকের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ফলে কৃষিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. জামাল উদ্দীন বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন ৩ গুণের বেশি, গম ২ গুণ, সবজি ৫ গুণ ও ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। সরকারের মনোযোগ, কৃষি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, উচ্চফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্বারোপ, সহজ কিস্তিতে ঋণব্যবস্থার কারণে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এসেছে। এছাড়া দেশে শিক্ষিত কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে কৃষকের ছেলেই কৃষক হবে— এমন ধারণা থেকে আমরা বের হতে পেরেছি।

তিনি বলেন, সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে।

এদিকে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ই-কৃষি খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার জানালা। কৃষি তথ্য সার্ভিস দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষি তথ্যকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনলাইনে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে মুঠোফোনের জোয়ারে ভাসছে এ দেশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুয়ায়ী, ১০ শতাংশ মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়লে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ হারে বাড়ে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ১৬১২৩ নম্বরে যে কোন মোবাইল থেকে ফোন করে নামমাত্র খরচে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট অফলাইন অথবা অনলাইনে সার সুপারিশ নির্দেশিকা প্রদান করছে। আখ চাষিরা মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে ই-পুর্জি সেবা গ্রহণ করছেন। এমনকি ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেশ-বিদেশের কৃষি তথ্যসেবা পাওয়া যাচ্ছে।

কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো চাল রফতানি শুরু করে সরকার। দুই দফায় প্রায় ৫০ হাজার টন চাল রফতানি করা হয়। এছাড়া ৬ মে ২০১৫ বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প কবলিত নেপালে ১০ হাজার টন চাল সাহায্য হিসাবে পাঠানো হয়েছে। এটা দেশের চাল উৎপাদনের সামর্থ্যরই বহিঃপ্রকাশ।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর