দলতন্ত্র গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) সাধারণ সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বর্তমান পর্যায়ে ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পূর্বপশ্চিম কথা বলে তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রফিক মৃধা।

বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে নাকি বিচার বিভাগের হাতে থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

বদিউল আলম মজুমদার: বিচারপতিতের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের নিকট থাকতেই পারে এবং অনেক দেশেই আছে। সেই সব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচারপতিতের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের কাছে দেওয়া উচিত নয়। যে দেশে মনোনয়ন বানিজ্য হয়; টাকার বিনিময়ে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিরাও এমপি হয়ে যাচ্ছে। এইখানটায় ওই এমপিরা যদি একজন বিচারপতিকে অভিশংসন করেন, সেটা তো ন্যায়সংগত হবে না। এছাড়া ষোড়শ সংশোধনী পাশের পরে সংসদে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তাতে স্পস্ট যে এদেশে সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আদালতে যে যুক্তি উপস্তাপন করেছে তা এই দাবিকে আরো জোরালো করে। সংসদ সদস্যদের যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দেখানো উচিত তা এসকল সংসদ সদস্যরা পারবে না। এদের তা নেই। সংসদ সদস্যরা ইচ্ছা করলেই দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে কোন মতামত দিতে পারে না। আমদের সংসদ সদস্যরা রাজনৈতিক যে কোন বিষয়ে দলীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটাবেনই। আদালত যেমন আশঙ্কা করছে আমাদের তেমন আশঙ্কা সংসদ দলীয় ভাবে বিচারককে অপসারন করতে পারে।

সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টে দুইটি বিভাগ আছে একটি জুডিশিয়াল আরেকটি আপিল বিভাগ। সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক এবং এটা বহু প্রচলিত ও বহুল গৃহীত। সংসদ আইন করতে পারে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তবে বিচারপতিতের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের নিকট থাকবে এটা সাংবিধানিক কিনা তা দেখার দায়িত্ব আদালতের। তাই আইনমন্ত্রী কিভাবে বললেন, এটা সংবিধান পরিপন্থি তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এটা আদালতের দায়িত্ব অন্য কারো নিরূপন করার এখতিয়ার নেই।

জাতীয় নির্বাচনের পর সিটি, পৌর, উপজেলাও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সর্ম্পকে আপনার পর্যবেক্ষণ কি ?

বদিউল আলম মজুমদার: ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তারপর থেকে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে নাই। অনেক জায়গায় নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলে হচ্ছে। এটা বড় সমস্যা। এখন বর্তমান সময়ে একটা স্লোগান উঠেছে- “চেয়ারম্যানের ভোট ওপেনে আর মেম্বরের ভোট গোপনে।” এসব মানুষকে ভোট দেওয়ার বিরাট বাধা। এটা নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে দারুন ভাবে প্রশ্নবিদ্দ করে।

এবাবের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে বেশি সহিংসতা ও প্রাণহানীর কারণ কি?

বদিউল আলম মজুমদার: ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে বেশি সহিংসতা ও প্রাণহানীর মূল কারণ হল দলীয় ভিত্তিতে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করা। যেহেতু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে, অর্থাৎ তা পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে গেছে। এটা এই পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নিশ্চিত বিজয়। এই অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য। শুভ-অশুভ অবৈধ উপায়ে টাকা পয়সা দিয়ে মনোনয়ন কেনা হচ্ছে। আরেকটা উপায় হচ্ছে সহিংসতার মাধ্যমে অন্যকে নির্বাচিত হওয়া থেকে বিরত রাখা। এসব সহিংসতা হয়েছে মূলত সরকারী দলের মধ্যেই। আর এসব কারণেই অধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। এসব ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা।দীর্ঘ মেয়াদী ধরে এটা হয়েছে। সহিংসতা শুরু হয়েছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার পর থেকেই। এখনও অব্যহত রয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হলেও ৪ ধাপে ৩৮৮ টি আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি কেন? আপনি কি মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার: এর কারণ আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি উন্নতি হয় নাই। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিরোধী দলের, সরকারের সাথে বা মহাজোটের সাথে জড়িত থাকলেও নিজেদের পছন্দের বা দলীয় প্রার্থী না হলে তাদের প্রার্থীতা জমাদান থেকে বিরত রাখা হয়। ফলে অনেকে প্রার্থী হতে পারে না। আবার বিরোধী দলের অনেকে প্রার্থী হতে চান না। এমনও দেখা গেছে, বিএনপির লোক হয়েও বিএনপির মার্কা না নিয়ে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছে। আরেকটি কারণ হলো, বিএনপি চাপের মধ্যে আছে তাই অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার বিনিময়ে প্রার্থী হননি। প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য হলে জনগণ কি যোগ্য প্রার্থী পায় ? আর এ নির্বাচনে বিজীয়রা কি জনগণের সেবা করতে পারে কি ?

বদিউল আলম মজুমদার : এটা বলার অপেক্ষা রাখে না অশুভ উপায়ে টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে পুরো প্রক্রিয়াটাই তারা ব্যবসায় পরিণত করতে চায়। তারা জয়ী হয়ে ব্যবসা শুরু করে দেয়। এতে যোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়নের দৌড় থেকে বাদ পড়ে যায়। অনেক ভাল ব্যাক্তিদের টাকা না থাকায় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়। অপর দিকে বিতর্কিত ও অসৎ ব্যাক্তিরা মনোনয়ন পেয়ে যায়। ব্যাপক ভোট কারচুপির মাধ্যমে তারা নির্বাচিত হয়ে যায়। এখন নির্বাচন আনুষ্ঠানিকতায় পরিনত হয়েছে।

সম্প্রতি দেশে খুনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এসব খুন জঙ্গী না অইএস করছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতির কারণ বলে আপনি মনে করেন ?

বদিউল আলম মজুমদার: এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতি হয়েছে। যারা মানুষের জান মালের নিরাপত্তা দিবে তারা দিতে পারছে না। সরকারে পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেই তাহলে দেশীয় জঙ্গী আছে। সরকারের এসব বক্তব্য যারা অপরাধ করছে তারা আরো উৎসাহী হবে। আমি মনে করি এগুলো মানবাধিকারের চরম লংঘন। মানবাধিকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারেরই দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের উচিত আসল জঙ্গীদের চিহিৃত করে আইনের আওতায় আনা। যারা রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে তাদের অপরাজনীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ছে। ধর্মীয় মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তির অপতৎপরতা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। যা শান্তিকামী মানুষের জন্য অস্বস্তিদায়ক। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের সকলকে সমস্বরে জেগে উঠতে হবে। দলতন্ত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে ধ্বংস করছে। দলতন্ত্র গণতন্ত্রের শত্রু। দলতন্ত্র গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। দলতন্ত্র সহিংসতাকে উস্কে দেয়। যারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে বিসর্জন করতে চায় এবং উগ্রবাদ সৃষ্টি করে, তাদের সমর্থন না করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর