শালবনে ঘেরা অপরূপ আলতাদীঘি

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বনের ভেতরে আঁকাবাঁকা পথের ধারেই কারুকার্যখচিত উই পোঁকার ঢিবি, বাহারী জংলী গাছের লতা পাতায় মোড়ানো প্রকৃতির আশির্বাদে দ্বারিয়ে আছে অগুণিত শাল গাছ। একটু এগিয়ে যেতেই মেঘেরা হাড়িয়ে যায় অগুনিত শালগাছের আড়ালে, হঠাৎ করে নেমে আসে অন্ধকার। অচেনা ফুলের ঘ্রাণে জেগে ওঠে প্রেম। শালপাতার মড়মড় শব্দে মনে পরে ছোটবেলায় দাদা দাদীর গল্পের বাঘ মামার কথা।

বলছিলাম শালবনে ঘেরা প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের কথা। নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে ভ্যান অথবা ইজিবাইকে করে উত্তরে মাত্র ৫ কি.মি. দূরেই এ উদ্যানকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির গর্ভে গড়ে উঠেছে সুবিশাল শালবন। সু-বিস্তৃত দীঘির উত্তর পাড়েই তারকাঁটায় ঘেরা ভারতের সীমান্ত ফাঁড়ি।

প্রায় ২৬৪.১২ হেক্টর এই বনভূমির ঠিক মাঝখানে ৪৩ একর আয়তনের বিশাল এই দিঘীর স্বচ্ছ পানিতে ফুটে থাকা হাজারো পদ্মফুল যে কোন ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে বিমোহিত করবে। প্রতিবছর শীত যখন জেঁকে বসে, তখন ভারত সীমান্ত ঘেষা এই দিঘীতে বিভিন্ন প্রজাতির নাম না জানা অতিথি পাখি এসে দিঘীর নির্মল পানিতে দাপিয়ে বেড়ায়। ডাহুক, পানকৌড়ির কলকাকলি আর তাদের চঞ্চল ওড়াউড়িতে মুগ্ধ হয় যেকোন বয়সের মানুষের হৃদয়।

কথিত আছে, আনুমানিক ১৪০০ সালে এ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা বিশ্বনাথ জগদ্দল। তখন রাজার রাজত্বকালেই একবার প্রজাসাধারণের খাবার পানির প্রকট সংকট দেখা দেয়। মাঠ-ঘাট শুকিয়ে চৌচির হওয়ায় আবাদি জমিতে ফসল ফলানো হয়ে ওঠে অসম্ভব।

হঠাৎ একদিন রানী স্বপ্নে দেখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পা ফেটে রক্ত বের হবে ততক্ষণ তিনি হাঁটতে থাকবেন এবং যেখানে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বের হবে ততদূর পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিলেই সেই দীঘি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাতেই পানির প্রকট অভাব থেকে মুক্তি পাবে প্রজাসাধারণ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাণী রাজার কাছে তার স্বপ্ন অনুযায়ী একটি দীঘি খননের দাবি জানালে রাজা চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। একদিন প্রেম পুজারী রাজা তার রাণীর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেন এবং একটি দীঘি খনন করে দিতে রাণীকে আশ্বস্ত করলেন। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দূর করবার জন্য রানী স্বপ্ন অনুযায়ী হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন। সঙ্গে ছিল রাণীর পাইক পেয়াদা, লোক লস্কর। একদিন রাণী হাঁটতে শুরু করলেন, হাঁটছেন তো হাঁটছেন বহুদূর হাঁটার পরও রানী থামছিলেন না। এভাবে রাণী হাঁটতে থাকলে পায়ে কষ্ট পাবেন ভেবে রাজা রাণীকে দাঁড়াতে বলেন। রাণী কথা না শুনেই প্রজাদের পানির কথা ভেবে হাঁটতেই থাকেন। রাণীর কষ্টের কথা ভেবে রাজা মন্ত্রী এবং উপস্থিত পাইক-পেয়াদাদের নিয়ে রাণীকে আটকানোর কৌশল বের করলেন। পাইক-পেয়াদারা রাজাকে বলেন, রাণীমার পায়ে আলতা না ঢেলে দিলে তিনি কখনোই থামবেন না। তখন রাজার হুকুমে তাদের একজন মন্ত্রী রানীর পায়ে আলতা ঢেলে দিলেন আর চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘রানী মা, আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। একথা শুনে রানী তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন সত্যিইতো পা থেকে রক্ত ঝড়ছে, আলতাকে রক্ত ভেবে রাণী সেখানে বসে পড়েন, প্রেম পুঁজারী রাজা বিশ্বনাথ জগদ্দল ওই স্থান পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিলেন। এরপর বিশুদ্ধ পানিতে ভরে ওঠে দিঘী। আর রাজা দিঘীটি আলতাদীঘি নামে নামকরণ করেন।

কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন দীঘিগুলির মধ্যে এটিই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সচল দিঘী। বিশাল দিঘী রামসাগরের দৈর্ঘ্য এটির চেয়ে ১৫০ মিটার বেশি হলেও চওড়ায় ১৫০ মিটার কম। শালবণ এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদে পরিপূর্ণ এই বনভূমিটি ২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রশাসনের নজরে এলে প্রাচীন ঐতিহ্যগত ইতিহাস পর্যালোচনায় এর গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। আর এ কারণেই আলতাদীঘিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। নওগাঁ শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার, জয়পুরহাট শহর থেকে মাত্র ১৯ কিঃমি। ঢাকা থেকে যেকোনো যানবাহনে খুব সহজেই এই দিঘীতে পৌঁছানো যায়।

আলতাদিঘী আমাদের দেশের একটি অন্যতম পর্যটন এলাকা হতে পারে, তাই এর পরিবেশ সুন্দর রাখা আমাদের সবার দ্বায়ীত্ব। বন বিভাগ ও একটি বেসরকারি সংস্থা-এনজিও দীঘি ও শালবনের জীববৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। ফলে বনাঞ্চলের বনভূমি নতুন করে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। বনাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে পাহারাদার বসানো হয়েছে। বনের মূল্যবান গাছপালা চুরি প্রতিরোধের জন্য বন থেকে শালপাতা সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আলতাদীঘির উত্তর ধারের বেশ কিছু অংশ ভারতে পড়েছে। এর ফলে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাঁটাতারের বেড়া ও দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার দেখার সৌভাগ্য হবে।

বনবিট কর্মকর্তা মান্নান জানান, জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে শালবন বনাঞ্চল ও আলতাদীঘি পর্যন্ত পাকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে বাস, মাইক্রোবাস, ভটভটি ও রিকশাভ্যান যোগে ধামইরহাট থেকে আলতাদীঘি পর্যন্ত চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ অনায়াসে পাড়ি জমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা শাল বাগানে বন বিভাগের উদ্যোগে ইতোমধ্যে ওষুধিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বাঁশ ও বেত লাগিয়ে বন্যপ্রাণী ও পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ বনাঞ্চলে অজগর, হুনুমান, বানর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, শিয়ালসহ প্রায় ২০ প্রজাতির পাখি অবমুক্ত করা হয়েছে। এতে একদিকে পর্যটক ও দর্শকদের আনন্দ ও বিনোদন যেমন বেড়েছে, তেমনি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজার রাখার জন্য এ বনাঞ্চল যথেষ্ট অবদান রাখছে। বর্তমানে দূর-দুরান্ত থেকে বিভিন্ন যানবাহন যোগে এ জাতীয় উদ্যান দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ।

তবে সুধীমহল মনে করেন, প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরপুর শালবনে ঘেরা আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর