নাটোরের বিলে সমলয় প্রযুক্তিতে কৃষির সম্ভাবনা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ট্রেতে করে পলিথিন মোড়ানো হাউজে বীজতলা তৈরী এবং পরম যত্নে মাত্র ২২ দিনেই রোপনের উপযোগী চারা প্রস্তুত। সেইসব পূর্ণাঙ্গ চারাগুলো এখন রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে লাইন লোগো পদ্ধতি ব্যবহার করে রোপন করা হচ্ছে জমিতে।

এতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠে ধানের চারা, সুবিধা হয় পরিচর্যার।

পোকা মাকড়ের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ব্যবহার করা হবে পার্চিং পদ্ধতি, খরচ কমাতে ব্যবহার করা হবে আধুনিক সেচের এডাব্লুডি (পর্যায়ক্রমিক শুষ্ক ও ভেজা) পদ্ধতি, সার ব্যবহার যথাযথ ও সীমিত করতে ব্যবহার করা হবে সুষম সার, অনায়াসে আগাছা নিধনে থাকবে উইডার মেশিন আর সর্বোপরি যুগপৎভাবে ধান কর্তন, মাড়াই এবং প্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হবে কম্বাইন্ড হারভেস্টার। যাকে বলে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষ চাষ।

এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বোরোর চাষাবাদ করছেন নাটোরের হালতিবিলের অন্তত ১৫০ জন কৃষক। এজন্য ১৫০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সমলয় চাষাবাদ স্কীম। সরকার এজন্য প্রায় ১২ লাখ টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন। এই প্রণোদনা কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকের জমি এবং সেচের খরচ বাদে ধানের বীজতলা তৈরী থেকে শুরু করে সমুদয় ব্যয় বহন করবে সরকার।

এবার নাটোর জেলায় প্রথমবারের মতো কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাইলট প্রোগ্রামের আওতায় নলডাঙ্গা উপজেলার হালতিবিলের পূর্ব মাধনগর ব্লকে ৫০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে হাইব্রিড ধান চাষ করা হচ্ছে। নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি পূণর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে পাইলট এই স্কীমের কার্যক্রম মনিটরিং করছে কৃষি বিভাগ। এই কার্যক্রম সফল হলে নাটোর তথা রাজশাহী অঞ্চলের কৃষির সম্ভাবনায় যুক্ত হবে নতুন দিগন্ত।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি হলো একটি নির্দিষ্ট মাঠে একই সময়ে একই জাতের ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে ফসলের রোপন ও কর্তণের সময় এবং উৎপাদন খরচ কমানো। একই সঙ্গে কৃষকদের সংগঠিত করে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকদের মেলবন্ধন তৈরী করা। যা আগামী দিনের আধুনিক কৃষির এক অপরিহার্য উদ্যোগ।

সোমবার (১৮ জানুয়ারী) দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনে বোরো ধানের আগাম চারা রোপন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসময় উপস্থিত ছিলেন নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার, নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মেহেদুল ইসলাম, নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা. ফৌজিয়া ফেরদৌস, উপজেলা সম্প্রসারণ অফিসার মো. কিশোয়ার প্রমুখ। একই সঙ্গে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে ধানের চারা রোপন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষও।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, সাধারণত প্লাষ্টিকের ফেমের মধ্যে ৩ঃ২ অনুপাতে মাটি ও গোবর দিয়ে বীজতলা তৈরী করা হয়। এরপর সেখানে বীজ ছিটিয়ে পুনরায় হালকা পরিমান মাটি ও গোবরের মিশ্রণ দিয়ে সমতল জায়গায় পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। একই পলিথিনের ছই বানিয়ে বীজতলা ঢেকে দেওয়া হয়। বীজতলা তৈরীর ৩ থেকে ৪ দিনের মাথায় অঙ্কুর বের হয়ে যায়। রাতে পলিথিনে ঢেকে রাখা হয় আর দিনে রোদ উঠলে পলিথিন সরিয়ে রাখা হয়।

কুয়াশা থাকলে দিনের বেলাতেও পলিথিন সরানো হয় না। জমিতে রোপন উপযোগী চারা প্রস্তত হতে ২২ থকে ২৪ দিন সময় লাগে। এই সময় পর্যন্ত গুনগত বীজ উৎপাদনে পলিথিন ব্যবহার করা হয়। আর জীবন চক্রের বেশি সময় জমিতে থাকায় পূর্ণ পুষ্টি পেয়ে ধানের কুশির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ধানের পরিমাণও বেশি হয়।

সূত্র আরও জানায়, ২০২০ সালের ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সাড়ে ৪ হাজার ফ্রেমে ৩০০ কেজি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড মালিক-১ ও পারটেক্স-৬ জাতের বীজ বপন করা হয়েছিল। যা ১৫০ বিঘা জমিতে রোপন করা হচ্ছে। সমলয় পদ্ধতিতে বোরো চাষাবাদে বীজতলা তৈরী থেকে ধান কাটা পর্যন্ত ১৩০ থেকে ১৪০ দিন সময় লাগে। বিঘা প্রতি গড় ফলন হয় ৩০ থেকে ৩৫ মন। এছাড়া উৎপাদন খরচ তুলনামূলক সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অনেক কম।

স্থানীয় সুবিধা ভোগি কৃষক সাইফুল ইসলাম জানান, আগে কখনও এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেননি। অনেকটা কৌতুহল বশত তিনি কৃষি বিভাগের পরামর্শে এই চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। তিনি এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ৯০ বিঘা জমিতে বোরোর চাষাবাদ করছেন। জমি আর সেচের খরচ বাদে সব কিছুই দেবে সরকার।

তিনি বলেন, এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বোরোতে লাভবান হলে আগামীতে আরও পরিধি বাড়াবেন। তার দাবি বন্যাপ্রবন হালতি বিলে আধুনিক এসব যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তি পর্যবেক্ষণ এবং অনুসরণ করে এলাকার অন্যান্য কৃষকরাও উপকৃত হবেন।

কৃষক আব্দুস সোবহান, মামুনুর রশীদ জানান, এই পদ্ধতিতে বীজতলা প্রস্তুত থেকে মাত্র ২২ দিনের মাথায় তারা চারা রোপন করতে পারছেন। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে লাইন লোগো পদ্ধতি ব্যবহার করে চারা রোপন করা হচ্ছে জমিতে। এতে চারাগুলো সতেজ থাকছে এবং নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে না।

কৃষক আবুল হোসেন জানান, প্রতিবছর হালতিবিলে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। ফলে ধান ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাসহ ধান কাটা শ্রমিকের অভাব এবং উচ্চ মূল্যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে সেসব সমস্যা থেকে তারা রক্ষা পাবেন বলে আশা করছেন। একই কথা জানালেন কৃষক আব্দুর রাজ্জাক, মাহবুর রহমানসহ আরও অনেকে।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা. ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, সকল প্রযুক্তির সমাহারে গড়ে তোলা এই স্কীমকে সফল এবং মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে কৃষি বিভাগ সব রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা করি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরাও স্বল্প সময়ে বোরো ধানে অধিক ফলন পাবেন। একযোগে কৃষকের ফসল উৎপাদন ও ঘরে তোলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বাংলানিউজকে বলেন, সমবায়ের মডেল অনুসরণ করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সকল প্রযুক্তির সাথে কৃষকের মেলবন্ধন তৈরীতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। আশাকরি পাইলট এই স্কীম সফলতা লাভ করবে। ভবিষ্যতে জেলার অন্যান্য উপজেলাতে এই কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে চাষাবাদে তুলনামূলক খরচ কম হবে এবং অধিক লাভ করবেন কৃষকরা। একই সঙ্গে কৃষকদের শ্রমিক সংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় হবে। এতে কৃষকের বোরো আবাদে আগ্রহ বাড়বে। কারণ জনসংখ্যার অনুপাতে দিন দিন কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। তাই অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য ধান ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

তাই সফল ভাবে এবং সঠিক সময়ে ফসল উৎপাদন, বিপনন করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রনালয় বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে এই সমলয় পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করতে চায়। এজন্য প্রনোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের এই চাষ পদ্ধতিতে বোরো ধান উৎপাদনে সহায়তা দিচ্ছে। সমলয়ে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকদের প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় তিন হাজার টাকা করে সাশ্রয় হবে বলেও এসময় জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর