আরেক হাতিরঝিল হতে পারে আদি বুড়িগঙ্গা

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ ঢাকার অচল খালের পর এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দৃষ্টি আদি বুড়িগঙ্গার দিকে। মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে এই সিটির খালগুলোতে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পেরেছে ডিএসসিসি। এবার অবহেলিত আদি বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করে পানির অবাধ প্রবাহ ফিরিয়ে আনা ও কামরাঙ্গীরচরকে আধুনিক শহরের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায় ডিএসসিসি। আদি বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে একটি খসড়া মাস্টারপ্ল্যানও হাতে নেওয়া হয়েছে। এখন এটি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।

করপোরেশন আশা করছে, প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে বলে আদি বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করতে সব বাধা ডিঙানো সম্ভব। কামরাঙ্গীরচর এলাকায় একটি আধুনিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনার কার্যক্রম চলছে।

২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কামরাঙ্গীরচর সরকারি হাসপাতাল মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় আদি বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধারে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন না পারলেও বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আদি বুড়িগঙ্গা উদ্ধার ও সেখানে নান্দনিক পরিবেশ গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছেন।

কামরাঙ্গীরচর বুড়িগঙ্গার বুকে জেগে ওঠা একটি চর। সেখানে রয়েছে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। জায়গাটি এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের অংশ।

বেড়িবাঁধ আর চরের মধ্যবর্তী জায়গায় বুড়িগঙ্গার একটি চ্যানেল ছিল আদি বুড়িগঙ্গা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদি বুড়িগঙ্গা আধমরা বুড়িগঙ্গায় রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের দখল আর দূষণে পানির প্রবাহ খুঁজে পাওয়া দায়।

আদি বুড়িগঙ্গার বর্তমান অবস্থা

সরেজমিনে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ সিকসনের (হাতির ঘাট) বিপরীতে কামরাঙ্গীর চরের রনি মার্কেট এলাকা। বেড়িবাঁধ থেকে চরে ঢুকতে হয় ছোট একটি সেতু পার হয়ে। প্রায় ৫০ ফুট দীর্ঘ সেতুর নিচে তাকালে এখন আর পানির প্রবাহ দেখা যায় না। এমনকি সেতু থেকে দুই পাশে তাকালে কোথাও পানির প্রবাহ দেখা যায়নি। বরং পানিপ্রবাহের বদলে সেখানে জমে আছে ময়লার বিশাল স্তূপ।

কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত আদি বুড়িগঙ্গা। প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেলটির দুই পাশে রয়েছে কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা। দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দীর্ঘ সময় ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ না থাকায় আদি বুড়িগঙ্গার ওপর গড়ে উঠেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন।

বেড়িবাঁধ ইসলামবাগ থেকে কোম্পানিঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের পাড় ঘেঁষে দেখা গেছে বিপুল অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে পাকা, আধাপাকা ও টিনের ঘর, রিকশার গ্যারেজ, ট্রাক স্ট্যান্ড, ট্রেম্পু স্ট্যান্ড, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারখানা। রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।

দখল-দূষণের পেছনে কারা?

স্থানীয় সূত্র জানায়, বেড়িবাঁধের সড়ক ও কামরাঙ্গীরচরের দুই পাশ থেকে ময়লা ফেলে আদি বুড়িগঙ্গা ভরাট করা হয়। ময়লা ফেলে ভরাটের পর সে অংশে গড়ে তোলা হয় রিকশার গ্যারেজ বা কাঁচা স্থাপনা। রনি মার্কেট অংশে খালের উপর গড়ে উঠেছে মার্কেটের বর্ধিতাংশ, পাকা স্থাপনা। দিনের পর দিন ময়লা ফেলে বেড়িবাঁধ অংশের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে বিশালাকার টেম্পুস্ট্যান্ড। কিছুটা পশ্চিম দিকে আদি বুড়িগঙ্গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড, দোকান ও বসতবাড়ি।

কোম্পানিঘাট এলাকায় খালের ওপর কায়দা করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে মেটাডোর কোম্পানি। মসজিদ বরাবর আদি বুড়িগঙ্গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে কোম্পানিটির কারখানা। মেটাডোরের পাশে থাকা পান্না ব্যাটারিও দখল করে আছে আদি বুড়িগঙ্গা। কোম্পানি দুটির বিপরীত পাশে রয়েছে স্থানীয়দের আরও অনেক অবৈধ স্থাপনা।

কামরাঙ্গীর চরবাসীদের একাংশের ভাষ্যমতে, দখলদারদের পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছেন ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হোসেন। এ বিষয়ে জানতে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।

কামরাঙ্গীর চরের পরে হাজারীবাগ, ঝাউচর, বউবাজার ও রায়েরবাজার অংশে আদি বুড়িগঙ্গার দেখা মেলে নামমাত্র। দুই পাড়ের বসতবাড়ি, বাজার ও কারখানা থেকে সব বর্জ্য ফেলে হচ্ছে জলাধারে। ফলে পানির প্রবাহের জায়গা ময়লার বিশাল স্তূপ গড়ে উঠেছে। ভাসমান এ ময়লার স্তূপ এতটাই পুরু হয়েছে যে- এর ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে। নিচে পানির প্রবাহ রয়েছে তা নিশ্চিত হতে অন্তত এক ফুট পরিমাণ ময়লা সরাতে হবে।

আদি বুড়িগঙ্গার জরিপ ও দখলদারদের তালিকা চলতি সপ্তাহে

এদিকে আদি বুড়িগঙ্গা নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন জনস্বার্থে সবচেয়ে বেশি মামলার আইনজীবী এবং মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

ঢাকা টাইমসকে তিনি জানান, তার দায়ের করা এক মামলায় বুড়িগঙ্গার সঙ্গে আদি বুড়িগঙ্গারও জরিপ হয়েছে। কিন্তু সে জরিপে কিছু ভুল থাকায় পুনরায় জরিপ করা হয়েছে। জরিপ ও দখলদারদের তালিকা চলতি সপ্তাহে আদালতে জমা হবে বলে জানান তিনি।

মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বুড়িগঙ্গার যখন জরিপ হয় তখন আদি বুড়িগঙ্গাও জরিপ করা হয়েছিল। আমার যে মূল মামলা সে মামলায় আমি আবার আবেদন করেছিলাম বুড়িগঙ্গার জরিপ করার জন্য। কতটুকু জায়গা নদীর মধ্যে আছে, কারা কারা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে? জরিপটা আগে হয়ে গিয়েছিল। পরিবর্তিকালে প্রশ্ন আসল, যে জরিপটা হলো, সেখানে কিছু জায়গা বাদ পরে গেছে। এ প্রশ্ন আসার পর আমি আবার আদালতে আবেদন করি। সে জরিপটাও হয়ে গেছে। আমি আশা করি, এ সপ্তাহে জরিপ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকাসহ আদালতে দাখিল হয়ে যাবে।

উচ্ছেদে বাধা দিলে আইনি ব্যবস্থা

রাজধানীর হাতিরঝিলের আদলে গড়ে তোলা খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে আদি বুড়িগঙ্গা খনন, অবকাঠামো উন্নয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী ঢাকা টাইমসকে জানান, বিষয়টি এখন প্রাথমিক অবস্থায় আছে। তারা আদি বুড়িগঙ্গাকে এখন পর্যবেক্ষণ করছেন। নদী দখল করে গড়ে তোলা সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।

আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, এখনো এটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এখনো স্ট্যাডি হচ্ছে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে। আদি বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করে কামরাঙ্গীর চর এলাকায় একটি আধুনিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের আছে। এখন স্ট্যাডি হচ্ছে, কার্যক্রম চলছে। আরও একটু সময় লাগবে।

দখল উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটা সামনে আসুক। অবৈধ স্থাপনা আমরা উচ্ছেদ করব। আশা করি, বড় প্রকল্প নিতে গেলে সবাই আমাদের সহযোগিতা করবে। কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কেউ যদি মনে করে যে, সে জায়গা দখল রাখবে, তখন আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব। আমাদের বিশ্বাস, কোনো সমস্যা হবে না।’

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর