রাজনীতি আছে রাজনীতি নেই

দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও এগিয়ে চলছে। ফুরফুরে মেজাজে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সব কিছু নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থাকলেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে খুশি ব্যবসায়ীরা। দেশকে এগিয়ে নিতে স্থিতিশীল পরিবেশই চান তারা। সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভিতও মজবুতের পক্ষে ব্যবসায়ীরা। কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন— এ নীতিতে বিশ্বাসী নয় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। ওই অংশের মতে, গণতন্ত্রের পাশাপাশি উন্নয়ন সমানতালে এগিয়ে চলবে।

অন্যদিকে সরকারি দল বলছে, দেশে কার্যকর সংসদ আছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও আছে। গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের ক্ষেত্রে খামতি থাকলেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এখন অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। রাজপথেও তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় তেমন শক্ত অবস্থানে নেই। মামলার পাহাড়ে বিপর্যস্ত দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী। রাজনীতিতে এখন চরম বেকায়দায় এ দলটি।

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও এখন সরকারের অতি তোষামোদিতে ব্যস্ত। নামেই তারা বিরোধী দল। বাম দলগুলোর বড় অংশই সরকারের সঙ্গে একাকার। বাইরে থাকা অন্য দলগুলোও নিষ্ক্রিয়। নানামুখী সংকটের পরও বর্তমান স্থিতিশীল অবস্থার ধারাবাহিকতা চায় সর্বস্তরের মানুষ। নাগরিক নিরাপত্তা আর ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ থাকলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে বলে মনে করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে যে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি নেই, তাতে সন্দেহ নেই। সরকার তো বলবেই সব ঠিকঠাকমতো চলছে। উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু যারা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরও দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো ভূমিকা নেই। বর্তমান বিরাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সরকার ও বিরোধী— দুই পক্ষই দায়ী। বিরোধী পক্ষ বলতে বিএনপিকেই বোঝাচ্ছি। সংসদে যে বিরোধী দল রয়েছে, এটা মোটেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিরোধী দল নয়। তারা সরকারেরই অংশ। অন্যদিকে বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোও বর্তমানে জনবিচ্ছিন্ন। কেউ সরকারে থেকে সুবিধা নিচ্ছে। কেউ সরকারের বাইরে থেকে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। দেশের রাজনীতিতে তাদের ইতিবাচক কোনো ভূমিকা নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর মতে, বিচ্ছিন্ন দু-তিনটি গ্রুপ সরকারকে অস্থিতিশীল করতে কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা আনসার আল ইসলাম বাংলা টিম বা যে নামেই ঘটনা ঘটাক তাদের শিকড় একটা— সেটা হলো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। আবার সরকারকে উত্খাত করাতে ইসরায়েলের মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। স্থিতিশীলতা বাড়ায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য আসছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। মহাসড়কে চার লেনের কাজও এগিয়ে চলছে। যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে এই স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থাকলে আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ দেশকে একটি উন্নত অবস্থানে নিয়ে গেছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের চেহারা পাল্টে যাবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আরেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোনো একটি অংশ না নিলে তাকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় না। বিগত সংসদ নির্বাচনে সেটাই হয়েছে। জনগণকে এ সরকারের আস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান সংসদে সেই অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের মাত্রা বাড়ছে। সরকার তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রয়োজন সব দলের সহযোগিতা নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় ঐকমত্য। তার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। সরকারকেই সে উদ্যোগ নিতে হবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশে গণতন্ত্রের শূন্যতা থাকলে কোনো সেক্টরই সঠিকভাবে চলতে পারে না। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি— কোনোটাই স্বাভাবিক গতিতে চলে না। দেশে এখন সব ক্ষেত্রে শূন্যতা বিরাজ করছে। বর্তমান সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। বিনা ভোটে নির্বাচিত। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা না থাকলে সব ক্ষেত্রেই অস্থিতিশীলতা থাকে। সেটাই বাংলাদেশে বিরাজমান।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘দেশে সুশাসন নিশ্চিত থাকার কারণেই দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি সব ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সাফল্য আসছে। শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্বের কারণেই। বর্তমান সরকার কোনো অপরাধীকে ছাড় দিচ্ছে না। অপরাধী যে দলেরই হোক তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে এমপিরাও এর বাইরে নন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটা কেবল শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণেই সম্ভব হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন সংসদে কার্যকর বিরোধী দল নেই। কার্যকর দল বলতে কী বুঝি? শুধু জ্বালাও-পোড়াও, টেবিল ভাঙচুর-হট্টগোল? এটা যদি হয়, তাহলে নেই। আর যদি বিরোধী দলের কাজ হয় সরকারের ভুল নীতির বিরোধিতা করা, ভালোকে ভালো বলা, সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো বলা— তাহলে বর্তমানে যে রাজনৈতিক দল বিরোধী দলে আছে, তারা সঠিক পথেই আছে বলে আমি মনে করি। বিরোধী দল মানেই সরকারের সব কিছুর বিরোধিতা নয়, সরকারকে সহযোগিতা করাও।’ জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলসহ ক্ষমতার বাইরে থাকা সব দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ গণতন্ত্রচর্চার বিকশিত পদ্ধতি এক দিনে হয় না। সময়ের প্রয়োজন। জাতীয় পার্টি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী।’ দেশে আইনের শাসনের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের আইনের প্রতি যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। নইলে দেশে আরও অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা পালন করতে হবে।’ সংসদে জাতীয় পার্টির ভূমিকা টেনে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সংসদে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। সরকারের কিছু নীতির প্রতিবাদে আমরা সংসদ থেকে ওয়াকআউটও করেছি। আমরা সব কিছুতেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করি। জ্বালাও-পোড়াও নীতি নয়, জাতীয় পার্টি আরও বেশি কার্যকর ভূমিকার চেষ্টা করছে। এতে আরও কিছু সময় লাগবে।’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নেতা হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসন নয়, বাংলাদেশে চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম শর্ত ভঙ্গ করে পেশিশক্তির রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ নির্বাচন এখন প্রহসনে পরিণত। সর্বশেষ তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যা দেখেছি তা কোনো ভোট ছিল না। পূর্বের সংসদ, সিটি করপোরেশনে একতরফা নির্বাচন হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদেও সন্ত্রাসের নির্বাচন হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে একের পর এক খুন করে চলছে। মৌলবাদীরা খুন করছে, সন্ত্রাসীরা খুন করছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধর্মীয় ব্যক্তিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুন হয়েছেন। তিনি নাস্তিক ছিলেন না। কুমিল্লার তনু খুন হলো। সরকার নির্বিকার। কোনো দায়দায়িত্ব যেন তাদের নেই। সবাই এখন ভয়ের মধ্যে আছি। সরকারের বিরুদ্ধে বলা যায় না। মৌলবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলা যায় না। তার অর্থ দুই দিক থেকেই দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি চলছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে বাম ধারার বিকল্প শক্তির প্রয়োজন। তবে বাম ধারার যে রাজনীতি চলছে, তার সাংগঠনিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। সরকারের ভিতরে যারা আছে, তাদেরও সাংগঠনিক ক্ষমতা খুবই কম।’ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি বর্তমানে অনেক ভালো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমরা সুনাম অর্জন করছি। তবে জঙ্গিবাদ নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্বে এ সমস্যাও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। দেশে সব সময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক— সেটাই আমরা চাই।’ অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘যারা বলেন দেশে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তাদের কাছে প্রশ্ন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই কেন? হত্যা, গুম, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত প্রতিবাদ নেই কেন? আসলে দেশে রাজনীতি, অপরাজনীতি কোনোটাই নেই। কবরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের বিরোধ নেই। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে গণতান্ত্রিক, ধাপ্পাবাজির উন্নয়ন নয়। স্বাধীনতার চেতনা ছিল সম্পদের সুসম বণ্টন। কিন্তু ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছেই, কমছে না। আর যে উন্নয়নের কথা সরকার সমর্থকরা বলছেন, এমন অগণতান্ত্রিক উন্নয়ন আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও এরশাদের আমলেও হয়েছিল। এটাকে উন্নয়ন বলা যাবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে। যার সবই অনুপস্থিত।’

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর