হাওরে কৃষকের আহাজারি, ১১৬ কোটি টাকার ধান শেষ

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ হাওরে যখন থাকার কথা সোনালী ধান, সেখানে এখন সাদা ধূসর রঙের আভা। এক রাতের গরম হাওয়ায় বদলে দিয়েছে হাওরের চিরচেনা রূপ। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কৃষকের স্বপ্ন। শুকিয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে মাঠের সোনালী ধান। আর এ কারণে কান্নার রোল পড়েছে হাওরপারের প্রতিটি পরিবারে। আগামী দিনে স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলার কৃষকরা।

জেলা কৃষিবিভাগের হিসাবে নেত্রকোনার ছয় উপজেলার বোরো ফসল ‘হিট শকে’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে- খালিয়াজুরী, মদন, কেন্দুয়া, মোহনগঞ্জ, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা। জেলার মোট ৭ হাজার ৪৪৪ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এরমধ্যে মদন উপজেলার ৩ হাজার ৩৯৮ হেক্টর জমি, কেন্দুয়ার ১৮৯ হেক্টর, খালিয়াজুরীর ৯৯৭ হেক্টর, বারহাট্টায় ৪৭৩ হেক্টর ও দুর্গাপুরে ৪৬ হেক্টরসহ জেলার প্রতিটি উপজেলার ক্ষতি হয়েছে। পুরো জেলায় ৪৪ হাজার ১৮০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ক্ষতি হওয়া জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪৪ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন ধান। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১১৬ কোটি ১২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।

তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও চাষিদের মতে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক জমির ধান কাটারই প্রয়োজন পড়বে না।

মঙ্গলবার ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল কেন্দুয়া ও মদন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করেছেন। দলটির প্রধান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহাম্মদ নাজমুল বারী হাওর পরিদর্শন শেষে বলেন, এটি এক ধরনের হিট শক। যেসব জমির ধান সবেমাত্র বের হচ্ছিল (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) অথবা ধানে চাল গজাচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ) সেসব জমিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত রোববার রাতে বয়ে যাওয়া গরম বাতাসের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের (ক্লাইমেট চেঞ্জ) কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছিল না। যদি বাতাসের সাথে বৃষ্টি হতো তাহলে এই ক্ষতি হতো না।

jagonews24

ঋণ করে তিন একর জমি চাষ করেছিলেন বল্লভপুর গ্রামের কৃষক হেলাল মিয়া। তিনি বলেন, হঠাৎ করে গরম বাতাস। ৬০ বছরের জীবনে এমন গরম বাতাস আর কখনও দেখি নাই। সকালে ঘুম থাইক্কা উঠে দেখি খেতের সব ধান মরে গেছে। আমরা কী খাইয়া বাঁচব। ঋণ করে গিরস্থি করেছি। এখন কী করে ঋণ শোধ দেব, কীভাবে সারা বছর সংসার চালাইব।

এ অবস্থা শুধু হেলাল মিয়ার একার না, হাওরের হাজার হাজার কৃষক পড়ে গেছেন এমন বিপাকে।

খালিয়াজুরীর কুড়িহাটি গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, আমার অন্তত ৪ একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু জমি এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেখানে আর কাঁচিই ধরা লাগবে না।

একই উপজেলার মেন্দিপুর গ্রামের বিএডিসির চুক্তিভিত্তিক বীজ উৎপাদনকারী আরিফ চৌধুরী বলেন, আমি বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ৮ একর জমিতে ব্রি-ধান ৭৪ ও ব্রি-ধান ৮৮ রোপণ করেছিলাম। এর পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় জমিগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। সমস্ত ধান চিটা হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সানোয়ারুজ্জামন চৌধুরী শোয়েব বলেন, ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের শতভাগ ফসল নষ্ট হয়েছে। এক ফসলি এ অঞ্চলের কৃষকদের ফসল একবার মার গেলে সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিন-চার বছর সময় লেগে যায়। সে হিসাবে বিগত দিনের ক্ষতিই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে। এর ওপর আবার নতুন এ দুর্যোগ হাজার হাজার কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানকার বেশিরভাগ কৃষকই ধারদেনা করে জমি চাষ করেন। ফসল তোলার পর বিক্রি করে পরিশোধ করে দেন। এবার অনেক কৃষক ঋণ শোধ করতে পারবেন না। তাই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারিভাবে পুনর্বাসন দরকার।

বারহাট্টার কৃষি কর্মকর্তা মোমাইনুর রশিদ জানান, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষিবিভাগ ক্ষতির হিসাব করছে। যেসব ধান গাছের শীষে রোববার ভোর থেকে সন্ধ্যায় গরম বাতাস প্রবাহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ফুল ফুটে বা পরাগায়ন হয় সেসব খেতের ধান শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সব ধানে চিটা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

মদন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হানুল হক জানান, গরম বাতাস ছাড়া বৃষ্টি কিংবা শিলা বৃষ্টি হলেও ধানের এমন ক্ষতি হত না। মাঠের যে ধান গাছগুলোতে ফ্লাওয়ার এসেছিল সেগুলো রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা কৃষকদের জমিনে পানি ধরে রাখার পরার্মশ দিচ্ছি। এতে কিছুটা রক্ষা হতে পারে।

jagonews24

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, ব্রি-ধান ২৯ এবং হাইব্রিড জাতের ধান খেতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ব্রি-ধান ২৮ মোটামুটি পেকে আসায় সেগুলোতে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। গরম বাতাসে ধানের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এমন ঘটনা আগে কখনো হয়নি। আমি বেশ কিছু এলাকা পরিদর্শন করেছি।

এদিকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু এমপি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মদন উপজেলার মাঘান ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি কৃষিমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের সরকারিভাবে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, রোববার সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে গরম বাতাস বয়ে যায়। বিশেষ করে রাত ন’টার পর থেকে বয়ে যাওয়া বাতাস গরম ছিল খুব বেশি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর