মমতার হাতেই পশ্চিমবঙ্গ

‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামীকাল’—রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হওয়া এই কথারই প্রতিফলন যেন পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। আর ১০টি নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের মতো এই নির্বাচনে একক দল হিসেবে শুধু তৃণমূল কংগ্রেস জিতল না, একই সঙ্গে জয়ী হলো বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনাও। কিংবা কথাটিকে ঘুরিয়ে বলা যায়, কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শের উপাসক বিজেপির মেরুকরণে বিশ্বাসী নন বাংলার ভোটাররা। কেননা তাঁদের মনে আগামীকালের ভাবনা আছে। তাই গেরুয়াকরণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও পরাজয় মেনে নিতে হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটিকে।

২৯২ আসনের (প্রার্থীর মৃত্যুতে দুটি আসনে ভোট হয়নি) মধ্যে ২১৪টিতে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। বিরাট বিজয়। তবে নন্দীগ্রামে নিজের আসনে হোঁচট খেয়েছেন মমতা। সেখানে ভোটগণনায় একবার মমতা এগিয়ে থাকেন তো পরক্ষণেই এগিয়ে যান বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। দিনভর এমন নাটকীয়তা চললেও নির্বাচন

কমিশন শেষমেশ বিজয়ী ঘোষণা করে শুভেন্দুকে, যিনি একসময় পরিচিত ছিলেন মমতার ডান হাত হিসেবে। তবে বিধায়ক হতে না পারলেও মুখ্যমন্ত্রী হতে কোনো বাধা নেই মমতার।

৭৪ আসন নিয়ে বিরোধী দল হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি)। তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ফের ক্ষমতায় থাকছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। ১২৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি, আসাম গণপরিষদ ও বোড়ো জনগোষ্ঠীর দল ইউপিপিএলের দখলে গেছে ৭৬টি। অন্যদিকে কংগ্রেস, এআইইউডিএফ ও বাম জোট পেয়েছে ৪৮টি আসন।

এ ছাড়া কেরালায় ক্ষমতার প্রত্যাবর্তন ঘটল শাসক শিবিরের। সিপিএমের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ জোট ৯৭ আসনে জিতেছে। রাজ্যটির বিধানসভার ১৪০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ পেয়েছে ৪২টি। বিজেপি এ রাজ্যে আসনের খাতাও খুলতে পারেনি।

আর তামিলনাড়ুতে প্রত্যাশামতো জয় পেয়েছে ডিএমকে-কংগ্রেস জোট। ২৩৪ আসনের মধ্যে তাদের দখলে ১৪৩টি। এআইএডিএমকে-বিজেপি-পিএমকে জোটও টক্কর দিয়েছে ভালোই; তারা পেয়েছে ৯০ আসন। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও প্রয়াত জয়ললিতার দলের এই ফল তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গতকাল রবিবার এ চার রাজ্য ছাড়াও ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরির নির্বাচনেও ফল ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে এনডিএ জোট পেয়েছে ১৪টি। এর বিপরীতে ইউপিএর ঝুলিতে সাতটি আসন।

ভারতের ২৮টি রাজ্য ও আট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে না আয়তন না জনসংখ্যা—কোনো বিচারেই পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান প্রথম নয়। আয়তনের দিক থেকে ১৪তম অবস্থান ও জনসংখ্যায় চতুর্থ শীর্ষে থাকা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের গুরুত্ব, এরপরও, বরাবরই বেশি। এবার বিজেপি একে ‘নিশানা’ বানানোয় গোটা ভারতের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন। সর্বাত্মক মেরুকরণের চেষ্টা, সব রাজ্য থেকে নেতাদের নিয়ে এসে ভোটের দায়িত্ব দেওয়াসহ প্রধানমন্ত্রী নিজে রাজ্যজুড়ে ৩০টি জনসভা করেছেন। এ ছাড়া তৃণমূল থেকে একঝাঁক মন্ত্রী, বিধায়ক, চেনা মুখ ও তারকা নেতা ‘ছিনিয়ে’ নিয়ে মমতাবিরোধী অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সব কৌশল, সূত্রই ব্যর্থ। ‘বাংলার মেয়ে’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরই আস্থা রাখলেন ভোটাররা।

তবে পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যেখানে মাত্র তিন আসন পেয়েছিল, আগের নির্বাচনে আসনের খাতাও খুলতে পারেনি, সেখানে এবার ৭৪ আসন পাওয়াও বিরাট ঘটনা। তবে তাদের লক্ষ্য ছিল সরকার গঠনের।

এ প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষকদের বড় একটা অংশের ভাষ্য ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতের ভোটের রাজনীতির খোলনলচে গত এক দশকে প্রায় পুরোটাই পাল্টে গেছে। এর ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও। গত নির্বাচনের পর থেকে এ রাজ্যের উপনির্বাচনগুলোতে বিজেপি যথেষ্ট ভালো করেছে। যে বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি, গত বছর বেড়ে দাঁড়ায় তা ১৮-তে। পরিসংখ্যানের এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা এবারও বিজেপির আসন বৃদ্ধির জোরালো ইঙ্গিত দেয়।

তবে ভোটের অঙ্কের হিসাবটা এতটা সরলসিধাও নয় বলে অনেকে মত দেন। তাদের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পা ফেলতে না পারা বিজেপির রাতারাতি বাজিমাত অসম্ভব। কেননা বাংলার রাজনীতিতে জাতপাতের ঠাঁই নেই—এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি তাকে বাজির তাস বানানোর মতো অবস্থাও তৈরি হয়নি। এর পরও প্রায় ১০০টি আসনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট। দলিত, আদিবাসী, রাজবংশী, গোর্খালিসহ দলিত, মতুয়া ও নিম্নবর্ণের (ওবিসি) হিন্দুদের ভোটও ৬ শতাংশের মতো। এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি দল তার মতো করে সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাংক কবজা করার চেষ্টা করে। কিন্তু বিজেপির উদ্দেশ্য সরাসরি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এ পর্যন্ত যতবারই সরকার পরিবর্তন হয়েছে, ততবারই কোনো না কোনো বড় ঘটনা ঘটেছে। ১৯৬৭ সালের আগে খাদ্য আন্দোলন, ১৯৭২ সালের আগে নকশাল আন্দোলন, ১৯৭৭ সালের আগে ইন্দিরা গান্ধীর ইমার্জেন্সি এবং ২০১১ সালের আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন। এটা কাকতাল হতে পারে না। তাই ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে এমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি, যাতে বিজেপি ‘আসল পরিবর্তন’ ঘটাতে পারে।

এর বাইরে জাতীয় পর্যায় ও রাজ্যের নির্বাচনে একই ভোটারদের পছন্দ পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। এর ইঙ্গিত মেলে গত এক বছরে হওয়া বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে। সর্বশেষ বিহার নির্বাচনে বিজেপির ভোট বাড়েনি। এর আগে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা—কোথাও লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিধানসভায় ভোট বাড়াতে পারেনি বিজেপি, উল্টো কমেছে। কোথাও কোথাও এই কমতির হার দুই অঙ্কের। পাশাপাশি কৃষক আন্দোলনে অনেকটা বেকায়দায় বিজেপি। সম্প্রতি পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির কারণও ছিল কৃষক আন্দোলন। ফলে হিন্দুত্ববাদ আর মোদি ম্যাজিকে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া পতাকা ওড়ার নিশ্চয়তা নেই।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর