মাছে-ভাতে বাঙালি উধাও দেশি মাছের আসল স্বাদ-গন্ধ

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ মাছে-ভাতে বাঙালি’-প্রবাদটি যথার্থ। দেশীয় টেংরা থেকে চান্দা; ইলিশ থেকে রুই-কাতলা-এসব মাছের ঝোল ভাতে মিশিয়ে তৃপ্তি মেটাত বাঙালি। কিন্তু এখন মাছের সেই আসল স্বাদ-গন্ধ ভুলতে বসেছে বাঙালি। কারণ অধিকাংশ মাছের স্বাদ-গন্ধ যেন উধাও হয়ে গেছে। সবগুলোতেই এখন স্বাদ-গন্ধ অনুপস্থিত।

দেশে একসময় প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাছ ছিল, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো নদী-নালা, খাল-বিলের সেসব মাছ চোখেই দেখেনি।

বর্তমানে অভ্যন্তরীণ মাছচাষে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় আর সার্বিকভাবে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত তিন দশক আগেও দেশি কিংবা চাষ করা বিদেশি মাছে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ ছিল। ওই সময় পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার ছিল, কৃত্রিম খাবার দেওয়া হলেও তাতে ক্ষতিকর কিছু ছিল না।

এখন পুকুর কিংবা যে কোনো জলাশয়ে চাষ করা মাছের একমাত্র ভরসা কৃত্রিম খাবার। মাছচাষ এখন এক প্রতিযোগিতার নাম। বেশি উৎপাদনের লোভে অল্প জায়গায় মাছচাষ করা হচ্ছে। নানা ধরনের খাবার দিয়ে এসব মাছ বেলুনের মতো ফুলিয়ে মোটাতাজা করা হয়। এ কারণেই এসব মাছে কোনো স্বাদ-গন্ধ নেই।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে এক সময় তিন শতাধিক দেশীয় প্রজাতির মাছ ছিল। এসব মাছ অধিকাংশই বিলুপ্তি হয়ে গেছে। তবে বিলুপ্ত হওয়া প্রায় ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ এখন বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে পাবদা, গুলশা, টেংরা, গুজি আইর, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, বালাচাটা, গুতুম, কুচিয়া, ভাগনা, খলিশা, গজার, চান্দা ইত্যাদি। তাছাড়া নদ-নদী, হাওড় ও বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিলুপ্ত প্রায় সব মাছ পুনরুদ্ধারে ব্যাপক হারে চাষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে দেশীয় মাছের যে স্বাদ-গন্ধ ছিল তা পুনরুদ্ধার করা মাছে পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য অপরিষ্কার পানি, কৃত্রিম খাবার এবং চাষপদ্ধতি দায়ী। মাছের উৎপাদন বাড়লেও সেই আগের স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার চাষ করা মাছে বিরক্তকর গন্ধও আছে।

যশোর জেলায় বড় মাছ ব্যবসায়ী অনন্যা ফিশের স্বত্বাধিকারী বিষ্ণুপদ সরকার জানান, এ জেলায় দেশীয় মাছের সঙ্গে ব্যাপক হারে রুই-কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাশ, কৈ প্রভৃতি মাছ চাষ করা হয়। প্রায় ১৫ হাজার জেলে এবং দুই হাজার বড় ব্যবসায়ী মাছচাষ-ক্রয় বিক্রয়ে সম্পৃক্ত। তবে স্বাদ-আর গন্ধে আগের মাছের ধারেকাছেও নেই চাষ করা মাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনা জেলার এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, মাছচাষের প্রতিযোগিতা চলছে। অল্প জায়গায় তুলনার চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি মাছ ছাড়া হচ্ছে। খাবার দেওয়া হচ্ছে প্রায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি। মাছ যেন ম্যাজিকের মতো বড় হচ্ছে। এসব মাছ খুব দ্রুত মরে যায়। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রাকে করে বিশেষ পদ্ধতিতে পানি ভর্তি ড্রামে করে মাছ পাঠানো হয়। এসব মাছের স্বাদ-গন্ধ দেশীয় আগের প্রজাতির ধারে-কাছেও নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস নদীতে একসময় প্রচুর মাছ ধরা পড়ত। এখন সেই নদী ভরাটের প্রতিযোগিতায় নেমেছে একশ্রেণির মানুষ। তাই জেলে থেকে শুরু করে মাছ চাষিরা এখন পুকুর, জলাশয়ে মাছ চাষে শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করছেন। আখাউড়া উপজেলার আবুল হাশেম, নোয়াব আলী, রউফ মিয়া, শাহ আলম, শিশিরসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি পুকুর ও জলাশয়ে মাছ চাষ করছেন।

শাহ আলম জানান, মাছ চাষে ভালো লাভ হচ্ছে। বিলে জমিতে পুকুর বানানো হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাষি জানান, একেকটি পুকুর-জলাশয়ে বছরে তিন-চারবার মাছ চাষ করা হচ্ছে। খাবারের ওপর খাবার দেওয়া হচ্ছে। এতে মাছ দ্রুত বড় হচ্ছে ঠিক; কিন্তু স্বাদ-গন্ধ নেই। খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।

চাষ করা কৈ, শিং, পুঁটি, টেংরা থেকে রুই, কাতলা, বোয়াল রাজধানীর বিভিন্ন মাছ বাজারে নদীর বলে বিক্রি হয়। চাষের কৈ আর শিং মাছ খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই উত্তম-বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন খিলগাঁও বাজারে আসা ক্রেতা মিনহাজ উদ্দিন।

আরেক ক্রেতা জানান, কৈ, শিং, মাগুর, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া প্রভৃতি মলমূত্রযুক্ত পানি কিংবা ডোবা পুকুরে চাষ করা হয়। সরপুঁটি, শোল, সিলভার কার্প, রুই, কাতলা, মৃগেল, টেংরা, চিতল, পাবদা পুকুরে চাষ করা হচ্ছে। চাষের মাছ দাম কম। এ কারণে একশ্রেণির ক্রেতা চাষের মাছই বেশি কিনে থাকেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জুয়েল শেখ জানান, মৎস্য চাষে দেশে বিল্পব ঘটেছে। বিলুপ্ত প্রায় মাছগুলোও পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। অর্থাৎ চাষের মাছেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫.০৬ লাখ মেট্রিক টন মাছ চাষ করা হয়। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৪৭ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। দেশে বছরে প্রায় ২৫ থেকে ২৬ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য খাবার (ফিশমিট) প্রয়োজন। এর মধ্যে দেশে তৈরি হয় প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। বাকি খাবার বিদেশ থেকে আসছে। কৃত্রিম এসব খাবারেই মাছ চাষ হচ্ছে। এতে মাছের স্বাদ-গন্ধে পার্থক্য হতে পারে। তবে পুষ্টিগুণ যথাযথ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, চাষ করা দেশি-বিদেশি সব মাছে কৃত্রিম খাবার দেওয়া হয়। সামুদ্রিক পচা মাছ, ট্যানারির বর্জ, সিসাসহ ক্ষতিকর ধাতু মেশানো হয় মাছের খাবারে। বিষাক্ত এই খাবারে বেড়ে ওঠা মাছ খেলে মানবদেহে ক্যানসারসহ নানা অসুখ দেখা দিতে পারে। এই খাবারে মাত্রারিক্ত ক্ষতিকর লিড, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়াম থাকায়-মাছ অস্বাভাবিক বড় হয়। একই সঙ্গে স্বাদ-গন্ধে পরিবর্তন হয়ে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ হারায়।

ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, বিষাক্ত খাবারের ধাতু মাছের শরীরে অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে। বিষাক্ত এই ধাতু মানবদেহে প্রবেশ করে এবং অপরিবর্তিত অবস্থায় বিভিন্ন অর্গ্যানে জমা হয়- যা পরে মারাত্মক রোগব্যাধির সৃষ্টি করে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আখতারুন নাহার আলো যুগান্তরকে বলেন, তার কাছে আসা অনেকেই জানান, মাছে স্বাদ-গন্ধ নেই। তিনি বলেন, অল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষ এবং অতিরিক্ত খাদ্য দিয়ে মাছ বড় করার প্রতিযোগিতার কারণে মাছ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। মাছ ধীরে ধীরে বড় হতে দিতে হবে।

কৃত্রিম খাবার দিলেও নিয়ম ও পরিমাণ মতো খাওয়াতে হবে। পুষ্টিগুণসহ প্রতিটি মাছেই আলাদা আলাদা স্বাদ-গন্ধ থাকে, যা পুষ্টির অন্যতম লক্ষণ। অধিক উৎপাদন যেন মানুষের কল্যাণে আসে-পুষ্টির বিপরীতে অকল্যাণ যেন ডেকে না আনে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, বিলুপ্ত হওয়া দেশীয় মাছ পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। এসব মাছ আবদ্ধ জলে চাষ হচ্ছে। তবে এই মাছের স্বাদ-গন্ধ উন্মুক্ত পানিতে বেড়ে ওঠা মাছের স্বাদ-গন্ধের মতো নয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, দেশীয় যেসব মাছ বিলুপ্তি হয়ে গেছে-সেগুলো পুনরুদ্ধারে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মাছের স্বাদ-গন্ধ বিষয়ে তিনি বলেন, স্বাদ-গন্ধ অটুট রাখতে হলে পানি পরিষ্কারসহ মাছের খাবারে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, চাষ করা দেশীয় মাছে পুষ্টিগুণের কোনো পার্থক্য নেই। শুধু স্বাদ-গন্ধে পার্থক্য।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর