ঋণের জালে হাওরের কৃষক

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ হাঁস ছিল এক হাজার। ধান লাগান ২০ বিঘা জমিতে। বাঁধ ভেঙে যায় চৈত্র মাসে। পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় ধান। আর বিষাক্ত পানি কেড়ে নেয় হাঁসের প্রাণ। আবার মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিনেছেন এক হাজার হাঁস। ঋণ এখন ছয় লাখ টাকা। কীভাবে শোধ করবেন এত টাকা? ঋণের জালে জড়িয়ে যাওয়া এই কৃষকের নাম জহির উদ্দিন। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মমিনপুর গ্রামের বাসিন্দা।

গত সাত দিন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা, শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জহির উদ্দিনের মতো বহু কৃষক, জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের খোঁজ মিলেছে, যাঁদের মাথার ওপর এখন ঋণের বোঝা।
এঁদের ভাষ্য, স্থানীয় মহাজন আর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে হাওরে ধান চাষ করেন। আশা ছিল, ঘরে ধান উঠলে সব ঋণ শোধ করে দেবেন। কিন্তু বাঁধ ভেঙে আসা পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে স্বপ্নের ফসল। অথচ বাড়িতে আসছে মহাজন, আসছে এনজিওকর্মী।
ঋণগ্রস্ত মানুষের ভাষ্য, এলাকায় কাজের বড় অভাব। আয়-রোজগার তেমন নেই। কিন্তু ঋণের টাকার সুদ আর কিস্তি তাঁদের দিতে হচ্ছে। তবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের টাকার জন্য কাউকে চাপ দেওয়া হচ্ছে না। যাঁরা স্বেচ্ছায় কিস্তি দিতে চাচ্ছেন, কেবল তাঁদেরটা নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা ঋণ শোধ করে আবার চাচ্ছেন, তাঁদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
বাক্‌প্রতিবন্ধী ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কৃষক আমিরুল ইসলাম। অসুস্থ হয়ে ঘরে আছেন তিনি। ছবিটি গত মঙ্গলবার ধরমপাশার জারাকোনা নয়াহাটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানগত ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জে গিয়ে কৃষকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কৃষিঋণ আদায় বন্ধ আছে। এনজিওর ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও নির্দেশ দেওয়া হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরপরই জেলা প্রশাসনও গত মে মাসে ঋণের কিস্তি আদায় পুরোপুরি বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেয়।
চলতি বছর জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়। এর মধ্যে ১৫৪টি হাওরের ধান তলিয়ে যায় পানিতে। সরকারি হিসাব বলছে, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। আর হাওরের পানিদূষণে মারা গেছে ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ। যে মাছের মূল্য প্রায় ৪১ কোটি টাকা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে বেশির ভাগ লোক ঋণ নিয়েছেন। ঋণের সীমা গড়ে ৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। একই ব্যক্তি একাধিক মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। বিনিময়ে এক হাজার টাকায় মাসে ১০০ টাকা করে সুদ গুনতে হচ্ছে তাঁদের।
অসুস্থ স্ত্রী নাজমা বেগমকে টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না আবদুল হাকিম। আবার মাথার ওপর আছে ৪০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা। ছবিটি গত সোমবার তাহিরপুর উপজেলার উমেদপুর পূর্বহাটি থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান৫৫ বছর বয়সী আমিরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। তাঁর বাড়ি ধরমপাশা উপজেলার জারাকোনা নয়াহাটি গ্রামে। ইউনিয়নের নাম উত্তর সুখাইর রাজাপুর। গ্রামের জসীম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে আট বিঘা জমিতে তিনি ধান চাষ করেন। ফসলডুবির পর থেকে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে যান। অথচ সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলে তিনি যে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দেন, তাতে তাঁর প্রতি সপ্তাহে ৫০০ টাকার ওষুধ লাগত। আয় না থাকায় এক সপ্তাহের ওষুধ কিনে আর কিনতে পারেননি। বাধ্য হয়ে স্বামীর চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরেছেন স্ত্রী তৈয়বা আক্তার। এখন ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন। আমিরুলের ভাষ্য, এমন অবস্থায়ও প্রতি মাসে সুদ দিতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ আজমত আলীর বয়স ৬০ বছর। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। সদর উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামে বাড়ি। গত বুধবার কাজের জন্য শহরে আসেন তিনি। আজমত আলীর ভাষ্য, গত তিন দিন শহরে এলেও কাজ পাননি। অথচ তাঁকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হচ্ছে। একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি।
মহাজনের ২০ হাজার টাকার ঋণে এলোমেলো ঈশ্বরচন্দ্র দাসের জীবন। মাছ ধরে তাঁর দৈনিক আয় মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকা। অথচ সুদ দিতে হচ্ছে নিয়মিত। ছবিটি জামালগঞ্জের জোতিন্দ্রপুর হালির হাওর থেকে গত মঙ্গলবার তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানস্থানীয় লোকজন বলছেন, ফসলডুবির পর মহাজন আর এনজিওর ঋণ কৃষকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকা ছেড়ে বহু নারী-পুরুষ ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে যাচ্ছেন কাজের আশায়। যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই হাওরে মাছ ধরাসহ নানা কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে আবার নতুন করে ঋণে জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
তবে জেলায় বড় তিনটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) শীর্ষ কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ঋণের কিস্তি আদায়ে কোনো চাপ দেওয়া হচ্ছে না। তবে তাঁদের কর্মীরা ঋণগ্রহীতাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। যাঁরা দিতে পারছেন, তাঁদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করা হচ্ছে।
হাওরে ঘর তলিয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় অস্থির জাকির হোসেন ও তাঁর মা। ছবিটি ৫ আগস্ট দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়ন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামানবেসরকারি সংস্থা ‘আশা’র জেলার ব্যবস্থাপক সমীরণ চন্দ্র রায়ের ভাষ্য, পুরোনো ঋণ আদায় বন্ধ। তবে নতুন করে ঋণ বিতরণ চলছে। তাঁদের কর্মীরা মাঠে আছেন। আর এনজিও ‘পদক্ষেপের’ জেলা ব্যবস্থাপক মুজিবুল হকও বললেন, সুনামগঞ্জে সুদের ব্যবসা বেশি। স্থানীয় মহাজনেরা সুদের কারবার করেন। এই মহাজনেরাই এনজিওর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালান।
অথচ দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুজ্জামান পাভেল বলছিলেন, স্থানীয় এনজিও কর্মকর্তাদের কিস্তি আদায় পুরোপুরি বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। আর তাহিরপুরের ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামও বলেন, কিস্তি আদায়ের চাপ প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামও বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন।
৬৫ বছর বয়সী মোখলেছুর রহমান শাল্লার ছায়ার হাওরে মাছ ধরে সংসার চালান। ছবি: আসাদুজ্জামানফসলডুবির পরপরই ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধের জোর দাবি জানিয়ে আসছে। তারা জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপিও দিয়েছে। সংগঠনটির আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি করেছিলাম; কিন্তু করা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, ৩০-৩৫ ভাগ মানুষ এলাকা ছেড়েছে। গ্রামে গ্রামে হাহাকার চলছে। মানুষ ঋণের ভারে জর্জরিত।’
তাঁর দাবি, কৃষিসহ এনজিওদের ঋণ এক বছরের জন্য পুরোপুরি মওকুফ করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর