বীরাঙ্গনা রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাস (৭৩) যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন

‘আমার এই একটাই চাওয়া। আমার মৃত্যুর পর যেন সন্তানদের পাশে মুক্তিযোদ্ধারা থাকেন।’ বীরাঙ্গনা রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাস (৭৩) যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন। এ কান্না কৃতজ্ঞতার কান্না। এ কান্না জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নতুন বাড়ি পাওয়ার আনন্দের কান্না। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এ বীরাঙ্গনা সাংবাদিকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ঢাকায় কালের কণ্ঠ’র বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেওয়া সংবর্ধনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললেন না তিনি।

মুুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের লঞ্ছনার শিকার গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার বীরাঙ্গনা রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাসকে গতকাল সোমবার নতুন বাড়ি উপহার দেয় জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে তাঁকে উপহার দেওয়া হয়েছে একটি গাভি ও নগদ টাকা। সাদুল্যাপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সামাদ ফুলমতির হাতে বাড়ির চাবি এবং গাভি ও অর্থ তুলে দেন।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘকাল রীতিমতো লড়াই করেছেন ফুলমতি। বারবার ছুটে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছেও। সাংবাদিকরাও এ নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে গণমাধ্যমে তুলে এনেছেন তাঁর দুর্দশার চিত্র। অবশেষে এ বছরের ১৪ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৩৩তম সভায় রাজকুমারী রবিদাসসহ আরো ২৬ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া তিনি সরকারিভাবে প্রতি মাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।

ভূমিহীন এ বীরাঙ্গনার জীবনে বাড়ি প্রাপ্তির আনন্দের মুহূর্তে গতকালের অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন সাদুল্যাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সামছুল হাসান, নারী ভাইস চেয়ারম্যান আকতার বানু লাকী, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু রায়হান দোলন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেছের আলী, সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবদুর রশিদ, সাদুল্যাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারিয়ার খান বিপ্লবসহ সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।

বাড়ি পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে রাজকুমারী ফুলমতি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে নীরব থাকেন। মুখ তুললে দেখা গেল তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন। চারদিকে তখন পিনপতন নীরবতা। খুব কষ্ট করে বললেন সেই পুরনো কথা। একপর্যায়ে বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া। মৃত্যুর পর শেষকৃত্যকালে আমার সন্তানের পাশে সবার সাথে যেন মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকেন।’

জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ ছিলেন আবেগাপ্লুত। বললেন, জাতির জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর জন্য কিছু করতে পেরে খুব ভালো লাগছে!

রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাস সাদুল্যাপুর উপজেলা সদরের উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত কুশিরাম রবিদাসের স্ত্রী। তিনি সাদুল্যাপুর উপজেলা শহরের ভূমি অফিসের সামনে রাস্তার পাশে সরকারি খাসজমিতে বসবাস করেন। অনেক দিন ধরে সেখানে একটি ঝুপড়ি ঘরে বাস করতেন তিনি। সেখানেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে নতুন বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ ছেলে-ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর সংসার। ফুলমতির ছেলে মণিরাজ রবিদাস বললেন, ‘জীবনের শেষ সময়ে এসে মা রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও বাড়ি পেয়েছেন। আমরা খুশি।’

পরে রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাস কালের কণ্ঠকে জানান, দেশের জন্য সেই নির্যাতন, লাঞ্ছনাকে আমি কলঙ্ক না ভেবে চিরকাল গৌরবের তিলক ভেবেছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ছোট্ট একটা মিনতি ছিল, আমার শিক্ষিত ছেলে মণিরাজ যদি একটা চাকরি পেত তাহলে শান্তিতে মরতে পারতাম। তাঁকে সম্মাননা দেওয়ায় তিনি কালের কণ্ঠকে কৃতজ্ঞতা জানান।

প্রসঙ্গত, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি রাতে স্থানীয় এক রাজাকারের মাধ্যমে হঠাৎ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা রাজকুমারী ফুলমতি রবিদাসের বাড়িতে প্রবেশ করে। পরে তাঁকে ঘর থেকে টেনে বের করে বাইরে এনে সম্ভ্রমহানি ঘটায় তারা। এভাবে কয়েক দফায় নির্যাতনের শিকার হন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভাব-অনটনে ১৯৮৮ সালে স্বামী কুশিরাম রবিদাস মারা যান।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর