বিভক্ত আওয়ামী লীগ সমস্যায় জর্জরিত বিএনপি

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বরগুনা সদর, আমতলী ও তালতলী উপজেলা নিয়ে বরগুনা-১ আসন। আর এ আসনের এমপি হতে সক্রিয় প্রধান দুটি দলের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আসনটি এবার দখলে নেয়ার চেষ্টায় মরিয়া বিএনপি। অন্যদিকে পরিবর্তনের ডাক নিয়ে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা। তাদের অভিযোগ, সারা দেশে উন্নয়ন হলেও স্থানীয় এমপির অবহেলার কারণে উন্নয়ন হয়নি বরগুনায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বরগুনায় জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের কার্যক্রম দেখা গেলেও তা খুব একটা আলোচনায় নেই। অভ্যন্তরীণ মেরুকরণ নিয়ে বরগুনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নানামুখী সমস্যায় রয়েছে। দুই দলেই রয়েছে সমন্বয়হীনতা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে একাট্টা দল ও এর সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় একটি গ্রুপ।
এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর কবির, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরগুনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি গোলাম সরোয়ার টুকু, সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান মিয়া, জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য গোলাম সরোয়ার ফোরকান ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মশিউর রহমান শিহাব।
সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজের পরাজয়ের জন্য দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডকে দায়ী করা হয়। ওই নির্বাচনের পর থেকে বরগুনায় আওয়ামী লীগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া যোগ্য নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার অভিযোগ রয়েছে বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে। বিগত নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগের যেসব তরুণ নেতৃত্ব ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাদের মধ্য থেকেই অনেকে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
সার্বিক বিষয়ে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচবার আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমার কাছে এমপি হওয়া বড় বিষয় না। আমার কাছে দল বড়। ১৯৯৬-২০০১ আমলে খাদ্য উপমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছি। বরগুনার জনগণকে এক করে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত করেছি। আমার ওপরে প্রধানমন্ত্রী আস্থা রেখে যতবার নৌকা প্রতীক দিয়েছেন আমি তার প্রতিদান দিয়েছি। দলের নেতাকর্মীদের মাঝে কখনও বিভেদ সৃষ্টি হতে দেইনি। আশা করি, আগামী নির্বাচনেও দল আমার ওপর আস্থা রাখবে।
জেলা যুবলীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল আহসান মহারাজ। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও ‘ওপেন সিক্রেট চক্রান্তের’ কারণে হেরে যান। নির্বাচনের দিন এক সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন তিনিসহ একাধিক নেতাকর্মী। এ ঘটনা দলের তৃণমূল ও জেলার নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জন্ম দেয়। এমনকি কেন্দ্রেও আলোচিত হয় ওই ঘটনা। এছাড়া দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এসব কারণে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে তার জন্য বিশেষ কোনো ঘোষণা আসতে পারে বলে মনে করছে মহারাজের সমর্থক নেতাকর্মীরা। এ ব্যাপারে কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, সারা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও বরগুনায় দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন নেই। তাই বরগুনার মানুষ নতুন নেতৃত্ব দেখতে চায়। গত পৌরসভা নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নৌকা প্রতীক উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু জেলার শীর্ষ কিছু নেতার অসহযোগিতার কারণে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছি। বরগুনার উন্নয়ন এবং মানুষের মাঝে আস্থা ফেরাতে পরিবর্তন দরকার।
সাবেক সংসদ সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান, এমনকি বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ‘বিদ্রোহের’ অভিযোগে দীর্ঘদিন দলের বাইরে থাকার পর দলের জন্য তার ত্যাগ ও একাগ্রতার প্রতিদান হিসেবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এতে তিনি জয়লাভ করেন। দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা বর্তমান কমিটির পরিবর্তন চাই। পরিবর্তন চাই মনোনয়নেরও। বরগুনায় পরিবর্তন দরকার।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, বরগুনা সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সহসভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকুকে নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখছে তার সমর্থক একটি অংশ। গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, বরগুনার সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা পরির্বতন চায়। দলের জন্য যুগের পর যুগ শ্রম দিয়েও দল থেকে অনেকেই কিছু পায়নি। আমি বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনের রাজনীতিকে এগিয়ে নেবেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা আটঘাট বেঁধে আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট তাদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য মো. মতিয়ার রহমান তালুকদার, জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক দলের সভাপতি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আব্দুল খালেক, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. নজরুল ইসলাম মোল্লার নাম আলোচনায় রয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী বিমান শ্রমিক দলের সভাপতি ফিরোজ উজ জামান মামুনকে নিয়েও আশাবাদী দলের একটি অংশ।
ভোটের রাজনীতিতে বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির অবস্থান অনেকটা দুর্বল। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত বরগুনার বিএনপি নেতাদের ও জেলার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নেতাদের মধ্যে চরম মতানৈক্য রয়েছে। জেলাশহরে অবস্থানরত নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগের হামলা, মামলা এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে দলের রাজনীতি তারা টিকিয়ে রেখেছেন। তাই নির্বাচনের সময় রাজধানী থেকে এসে কেউ মনোনয়ন নিয়ে উপস্থিত হবেন, তা মেনে নেয়া হবে না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলায়। তার সঙ্গে দলীয় চেয়ারপারসনের ভালো সম্পর্ক থাকায় জেলার রাজনীতিতে তার হয়ে একটি গ্রুপ কাজ করছে। ফলে জেলা কমিটির সঙ্গে খন্দকার মাহবুব হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে একটা বিরোধ চলছে। বিএনপির দাবি সহায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের জবাব দেবে জনগণ এবং বিএনপিই জয়লাভ করবে।
জেলা বিএনপির সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা বলেন, যারা কখনো, কোনো দিন রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। জেল-জুলুমের শিকার হননি এ রকম অনেক নেতাকর্মী এখন বিএনপিতে খবরদারি করছেন। বেশ কিছু নেতা রয়েছেন, যারা সারা বছর ঢাকায় থাকেন অথচ নির্বাচন কিংবা কমিটি গঠনের আগে আগে তাদের তোড়জোড় দেখা যায়। অথচ আমাকে আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন, হামলা, মামলার শিকার হয়ে জেল খাটতে হয়েছে। এখনও একের পর এক মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে বরগুনায় বিএনপির রাজনীতি ধরে রেখেছি। দল আমাকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ সকলে মিলে জনগণের ভোটে বিজয় লাভ করে এ আসনটি দলকে উপহার দিতে পারবো। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মো. মতিয়ার রহমান তালুকদার বলেন, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য, ১৯৮৯ সালে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দল থেকে মনোনয়ন দিলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বরগুনা-১ আসনটি বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে আরো শক্তিশালী করতে পারবো।
বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক দলের আহবায়ক লে, কর্নেল (অব.) আব্দুল খালেক বলেন, চাকরি ছেড়ে এসে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছি। তৃণমূল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। তাছাড়া রাজনীতি করতে গিয়ে মিথ্যা মামলা ও হামলার শিকারও হয়েছি। দলের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করতে হয়েছে। বর্তমানেও আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে মাঠে সোচ্চার হয়ে কাজ করছি। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে আমি দলের মনোনয়ন চাইবো এবং দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আশা করি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জয়লাভ করতে পারবো। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উজ জামান মামুন মোল্লা বলেন, অবহেলিত বরগুনাকে এগিয়ে নিতে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। এ আসনটি উদ্ধার করতে অবশ্যই কেন্দ্র ভেবেচিন্তে প্রার্থী বাছাই করবেন।
বরগুনায় জাতীয় পার্টির কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই। জাতীয় পার্টির বরগুনা জেলা সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. জাফরুল আহসান ফরহাদের মৃত্যুর পরে মাঠে নেই নেতাকর্মীরা। বরগুনায় এরশাদ সরকারের আমলে দাপিয়ে বেড়াতো জাতীয় পার্টি। সেখান থেকে এখন দলের কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মাঝখানে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি রমরমা হলেও এখন নেই তার প্রভাব। দলীয় কোনো কাজ না থাকায় অফিসও খুলছে না কেউ। নেতাকর্মীরাও তাদের ব্যাক্তিগত কাজ নিয়েই ব্যস্ত। এর মধ্যে থেকেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে পারেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মো. শাহজাহান মানসুর।
এ ব্যাপারে শাহজাহান মানসুর বলেন, জাতীয় পার্টি এক সময়ে বরগুনার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে বিভিন্ন কারণে সেই ধারা এখন আর নেই। তবে আবারো দলের সব নেতাকর্মীকে এক করে বরগুনা-১ আসনটি পল্লীবন্ধু এরশাদকে উপহার দিতে চাই।
অন্যদিকে ১৯৯১ সাল থেকে বরগুনা-১ আসনে ভোটের রাজনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তাদের প্রভাবশালী নেতা কেওড়াবুনিয়া পীর আব্দুর রশিদ বার্ধক্যজনিত কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। এ দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায়, ইসলামী কৃষক শ্রমিক আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. মুফতি মাহবুবুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর বরগুনা জেলা কমিটির সহসভাপতি মো. শাহ আলম তালুকদারের নাম শোনা যাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর