সৌদি আরবে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিন

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ‘খাইতে দেয় না। গোসলের ব্যবস্থা নেই। রাতে থাকি মরুভূমির মধ্যে টিনের চালা দেয়া ক্যাম্পে। দিনের বেলা সেখানে গরমে টেকা যায় না। আশেপাশে জনবসতিও নেই। ভোর হলেই তাই রাস্তায় চলে যাই।

রাস্তার পাশেই শুয়ে, বসে, কষ্টে কাটে দিন। সকাল হলেই ডাস্টবিন হাতড়াই। সেখানে সৌদিদের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবার  খেয়ে দিন পার করে দিই। কোম্পানি থেকে ৩-৪ দিন পর পর ডাল-ভাত দেয়া হয়। সেটাও আধপেটা। তাই ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খাবারই ভরসা।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সৌদি আরবে কাজে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মী রাজিব খান। আক্ষেপ করে বলেন, ‘পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য সৌদি আইছিলাম। অনেক আশা নিয়ে আইছিলাম। কিন্তু নিজেই বাঁচতে পারছি না। জীবনডা শ্যাষ করে ফালাইছি ভাই। ৬ লাখ টাকা খরচ করে আইছি। এখন বাড়িতেই বা যাবো কিভাবে?’ কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে থাকেন, ‘তারপরও বাড়ি যেতে চাই, এখানে জীবনডা শ্যাষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ি পাঠাতে ৩ লাখ টাকা চায় কোম্পানি। এ টাকা দেয়ার সাধ্য নাই।’ রাজিব খান দেশটিতে গেছেন চলতি বছরের ১৭ই এপ্রিল। এরপর থেকে কাজ করেছেন দিনে ১২ ঘণ্টা করে। এই সময়ে বেতন পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার টাকা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতন চাওয়ায় তাকে মারধর করে কোম্পানির ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর থেকেই তার এই দুর্ভোগ। আগে দুর্ভোগ থাকলেও অন্তত ডাস্টবিনের খাবার খেতে হতো না তার। রাজিব একাই নন। ওই ক্যাম্পে এ ধরনের মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রায় দেড় শতাধিক বাংলাদেশি। তাদের কেউ ৬ মাস, কেউ তিনমাস আবার কেউ তারও বেশি সময় ধরে এই অবস্থায় ক্যাম্পে রয়েছেন। তারা বাড়ি ফিরতে চাইলেও ৩ লাখ টাকা না দিতে পারায় কোম্পানি তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে না। এমনকি আকামাও কেড়ে নিয়েছে, যেন পালিয়ে যেতে না পারেন। বাংলাদেশিরা জানান, তিন-চারজনের বেশি তাদের একসঙ্গে থাকতে দেয়া হয় না। এক জায়গায় জড়ো হলেই চলে নির্যাতন। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের ধৈর্য্য ধরতে বলছে। আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে। এমনকি দূতাবাসে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এসব কর্মীদের।
চাঁদপুরের মতলব থানার বাসিন্দা রাজিব খান বলেন, তিনি গত ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি রহমানিয়া করপোরেটের মাধ্যমে সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত মেসার্স মাযায়া আল-দোহা কনস্ট্রাকশন নামে একটি সাপ্লাই কোম্পানিতে কাজ নিয়ে যান। পরদিন তাকে কাজে নিয়ে যাওয়া হয় জেদ্দার সাফারি ক্যাম্পে। প্রথম মাসে কাজের পর তাকে মাত্র ২ হাজার টাকা দেয়া হয়। এরপরও কাজ করতে থাকেন। কিন্তু বেতন আর পাননি। এভাবে ৫ মাস কেটে যায়। বেতন চাইলেই চলে নির্যাতন। এক পর্যায়ে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের কয়েকজন কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে মারধর করে ওই ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়া হয়। পরে রাস্তায় অবস্থান করেন। এর তিনদিন পর আকামা কেড়ে নিয়ে একটি হোটেলে আটকে রাখে। পরে তাদের রিয়াদের কোম্পানির ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপরই তাদের ওপর নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। রাজিব বলেন, ‘খাবার চাইলেই তারা বলছে, আমাদের না খাইয়ে কুকুরের মতো মারবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখানে পানি নেই। সকালে নাস্তা খাই ময়লা বালতি থেকে রুটি কুড়ায়ে। দুপুরে না খেয়ে থাকি। রাতে আবার ময়লার বালতি থেকে খাবার কুড়ায়ে খাই। আর তা না হলে না খেয়ে থাকি।’ তিনি বলেন, তারা যে ক্যাম্পে আছেন, সেখানে দেড়শ’ জনেরও বেশি বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। এরা প্রত্যেকে ৬-৭ লাখ টাকা করে দিয়ে সৌদি আরব এসেছে। কেউ ধার করে, কেউ সুদে টাকা নিয়ে। তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করেছেন, দূতাবাসের লোকজন ৩ দিন আসছে, তারপর আর ফোন রিসিভ করে না। এই কোম্পানিতে থাকলে না খেয়ে মারা যাবেন বলেন আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
রিয়াদের একই কোম্পানির ক্যাম্পে অবস্থান করা টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাসিন্দা সেলিম জানান, তিনি ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে দেশটিতে গেছেন। সেখানে যাওয়ার পর দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে তাকে কাজ করার জন্য পাঠানো হয়। একেক এলাকায় ২০-২৫ দিন করে কাজ করে আবারো ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি বলেন, যে এলাকায় কাজে পাঠানো হয়, সেখানে কাজ শেষ হয়ে গেলে নিজ খরচে আবার ক্যাম্পে ফেরত আসতে হয়। এভাবে প্রায় পাঁচ মাস কাজ করার পর এক টাকাও বেতন দেয়নি কোম্পানি। ফলে এরইমধ্যে ৬৫ হাজার টাকা বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে নিজের খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগানো হয়েছে। যেহেতু বেতন দেয় না এবং কর্মস্থল থেকে ক্যাম্পে ফিরতে হয় নিজ খরচে, তাই গত তিনমাস আর কোথাও কাজে যাই না। তিনি বলেন, তিন-চার দিন পর একদিন ডাল-ভাত দেয়। বাকি সময় সৌদিরা ডাস্টবিনে যে খাবার ফেলে দেয়, তা কুড়িয়ে খাই। তিনি বলেন, ‘এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। দেশে চলে আসতে চাই। কিন্তু কোম্পানি তিন লাখ টাকা চায়।’ ওই টাকা না দিলে আরো দু’বছর এভাবে থাকতে হবে বলেও আরবীয় এই কোম্পানিটি তাদের জানিয়ে দিয়েছে। এছাড়া তারা যেনো পালিয়ে যেতে না পারে এজন্য আকামাও কেড়ে নেয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার বাসিন্দা হাফিজুর জানান, তিনি গত এপ্রিলে ৬ লাখ টাকা দিয়ে সততা এসোসিয়েটস্‌ নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এই কোম্পানিতে কাজ নিয়ে যান। গিয়ে দেখেন, আরো অনেক বাংলাদেশি ওই ক্যাম্পে অবস্থান করছে। পরদিন তাকে মক্কার রাস্তায় ঝাড়ু দেয়ার কাজে পাঠানো হয়। সেখানে ৩ দিন কাজ করার পর ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনে। পরে আরেক জায়গায় পাঠানো হয়। সেখানে একদিন কাজ করার পর বলা হয় কন্ট্রাক্ট শেষ। ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি বলেন, প্রতিবারই কয়েক মাসের কথা বলে কাজে পাঠায়। কিন্তু এক-দু’দিন পরেই ফেরত পাঠায়। এই কাজ করানো বাবদ কোনো টাকা দেয়া হয়নি তাকে। এরপর আর কোনো কাজও দেয়া হয়নি। তখন থেকেই ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। এদিকে সততা এসোসিয়েটস্‌-এর ম্যানেজিং পার্টনার মো. আবদুল মান্নান বলেন, তাদের মাধ্যমে সৌদিতে কোনো পুরুষকর্মী যায়নি। মূলত তারা দেশটিতে নারীকর্মী পাঠিয়ে থাকেন। তবে তিনি বলেন, হাফিজুর নামে ওই ব্যক্তির যাওয়ার ব্যাপারে তাদের অফিসের কেউ লিয়াজোঁ করতে পারেন। তিনি মূলত গিয়েছিলেন উইনার ওভারসিজ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে। আবদুল মান্নান আরো উল্লেখ করেন, ওই সময় বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৯০০ কর্মী আল-দোহা কনস্ট্রাকশনে কাজ নিয়ে গিয়েছিলো। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেই কাজ পাননি। তবে এখন বেশিরভাগই কাজ পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে সৌদিস্থ বাংলাদেশি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, আল দোহা কোম্পানির কোনো বিষয়ে আমাদের জানা নেই। তবে যদি কর্মীদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাই, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবো। ইতিপূর্বে দূতাবাসের প্রতিনিধিরা তিনবার সেখানে পরিদর্শনে গেছেন এবং পরে আর তারা ভুক্তভোগী কর্মীদের ফোন রিসিভ করছেন না, এমন অভিযোগের ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত বলেন, কারা সেখানে গিয়েছিলো বিষয়টি খোঁজ নিতে হবে। এখন তিনি অফিসের বাইরে আছেন তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর