রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষা ও বিনোদন

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কী হবে তাদের শিক্ষা, কোন ভাষায় পড়ানো হবে-তা নিয়েও চলছে বিভিন্ন আলোচনা ও পর্যালোচনা। কতজন শিশু বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযুক্ত বয়সের, এ তালিকা করছেন দুই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেও শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার। দেশ ছেড়ে আসার আগের দুঃসহ স্মৃতি যেন এসব শিশু ভুলে থাকে, সে জন্য বিভিন্ন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্যোগও নিচ্ছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এর মধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের স্মার্ডকার্ড দেওয়া শুরু করেছে সরকার। শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের দুই ভাগে বিভক্ত করে তালিকা তৈরির পাশাপাশি তাদের স্মার্টকার্ড দেওয়া হচ্ছে। এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের ডাটাবেইস তৈরি করা হচ্ছে। এতে আলাদাভাবে শিশুদের চিহ্নিত করে আলাদা ক্যাম্পে রাখা সম্ভব হবে। ফলে আগের নিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোয় যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেভাবে নতুন আসা শিশুদেরও সাধারণ শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গাদের আগে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনটাই সর্বাগ্রে দেখছে সরকার। একটু সামলে উঠলে তাদের শিক্ষাদান নিয়ে কার্যক্রম নেওয়া হবে। তবে এ নিয়ে ইতোমধ্যে পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার মতো আবাস ও খাদ্যের সংস্থান করছে সরকার। পাশাপাশি শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি চিন্তা করা হচ্ছে। তারা জানান, প্রতিটি শিশুর শিক্ষালাভের অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। অভিবাসী শিশুদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (ইউএনএইচসিআর) একটি কৌশলপত্র (২০১২-১৬) গ্রহণ করেছিল। সেখানে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতের মাধ্যমে অভিবাসীদের দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই কৌশলপত্রের আলোকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করছে সরকার। বিশেষ করে ক্যাম্পের আশপাশে তাদের জন্য নতুন বিদ্যালয় তৈরি করে শিক্ষা-সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করার কথাও ভাবছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শরণার্থী শিশুদের স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এসব শিশুকে মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষকও নেই। তাদের বাংলা বই পড়ানো যাবে না বলে এর মধ্যে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় এনজিও পরিচালিত কোনো বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ালে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ভর্তি হতে না পারে, এ ব্যাপারেও সতর্ক শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিষয়টি বাঙালী কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে-রোহিঙ্গাদের শিশুকে তাদের মাতৃভাষায় পড়াতে হবে। কারণ, তারা দেশে ফিরে গেলেও পরে যেন তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ও শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পায়।’

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন, ইন্টারন্যাশনালের’ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হ্যালে থরনিং স্মিথ সম্প্রতি তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী শিশুর সংখ্যা চার লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে নতুন আশ্রয় নেওয়া শিশুর সংখ্যা দুই লাখ ৭০ হাজার।’ সংস্থাটি ২০১৮ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের সুরক্ষায় ৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে। এ পর্যন্ত সংস্থাটি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এক লাখ ৪৯ হাজার ৫৫০ জন রোহিঙ্গা শিশুকে সুরক্ষার আওতায় এনেছে।

এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য আরো এক হাজার ৩০০টি শিক্ষাকেন্দ্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এ ঘোষণা দেয় সংস্থাটি। ইউনিসেফ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও অস্থায়ী বসতিগুলোয় বর্তমানে ১৮২টি শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করছে। এগুলোতে ১৫ হাজার শিশু নিবন্ধিত রয়েছে। শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা দেড় হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে ইউনিসেফ। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য পরিচালিত মোট শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৫০০টিতে উন্নীত করবে ইউনিসেফ। যাতে আগামী বছরের মধ্যে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশুর কাছে মৌলিক শিক্ষা পৌঁছাতে পারে।

ইউনিসেফের শিক্ষাকেন্দ্রে চার থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের অনানুষ্ঠানিক মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা হবে শিফটের ভিত্তিতে, যেখানে প্রতি শিফটে ৩৫ জন করে শিশুকে শিক্ষা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেইগবিডার বলেন, ‘চলমান সংকটে অনেক দুর্ভোগ পার করে আসা এসব শিশুর জন্য নিরাপদ ও সুষ্ঠু বিকাশের মতো পরিবেশে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু তাদের দরকারি স্বাভাবিক প্রেক্ষাপট তৈরি নয়, বরং একই সঙ্গে সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়ার জন্যই এটি এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’

তথ্য মতে, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য কুতুপালংয়ে অনিবন্ধিত ক্যাম্পে ইউনিসেফের সহায়তায় কক্সবাজারভিত্তিক এনজিও ‘মুক্তি’ ৭৬টি বিদ্যালয় খুলেছে। এসব বিদ্যালয়ে ইংরেজির পাশাপাশি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিশুদের বার্মিজ বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোয় ১০৬ জন বাংলাদেশি শিক্ষক আছেন। এর বাইরে বার্মিজ বর্ণমালা জানেন-এমন আছেন আরো নয় শিক্ষক।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর