আমি ভয় পেলে তো জঙ্গিরা জিতে গেল

জঙ্গিরা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু, ইসলামের শত্রু। আমি যদি ভয় পাই, তাহলে তো জঙ্গিরা জিতে গেল।  এখানে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। আমি বরং এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে মানসিকভাবে দৃঢ়তাপূর্ণ অবস্থায় আছি।  বলিয়ান আছি।

জঙ্গিদের আক্রমণে আমি আতঙ্কিত নই, আতঙ্কিত হওয়ার যথাযথ কোনো কারণও নেই।  জঙ্গিদের পারপাস সার্ভ করতে দিতে পারি না আমি।

একটি দৈনিককে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ।

তিনি বলেন, মৌলিকভাবে শোলাকিয়ার এই হামলায় আমি নিজেই উপলক্ষ্য হতে পারি, শোলাকিয়ার ময়দান একটা উপলক্ষ্য হতে পারে, মসজিদে নববী একটা উপলক্ষ্য হতে পারে। কেননা, ওদের মূল দর্শনটাই তো ফ্যাসিবাদী দর্শন। তাদের কোনো একটা চিন্তাচেতনা জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে সমাজের মধ্যে, মানুষের ভেতরে।  তাদের এই দর্শন প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের মূল টার্গেট। এটাকেই তারা ইসলামের নামে পরিচিতি চাচ্ছে।

ইসলাম কখনোই বর্বর, নিষ্ঠুর, হিংস্র ধর্ম নয়।  ইসলাম হচ্ছে প্রেম, ভালোবাসা, সহিষ্ণুতা, উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবসেবার ধর্ম। জঙ্গিরা ইসলামকে ভুলভাবে প্রচার, প্রকাশ বা পরিচিত করতে চাইছে, এটার বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম, হুঁশিয়ারি ও প্রয়াস। কারণ ইসলামকে আমরা বিকৃত হতে দিতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, জঙ্গিদের নিজস্ব দর্শন রয়েছে। সমর কৌশলও আছে তাদের। জঙ্গিদের সমর কৌশলই হচ্ছে- মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। অনেকটা হিটলারের সমর কৌশলের মতোই। মানুষকে আতঙ্কিত করার কারণ, আতঙ্কিত মানুষ সাধারণত প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে ফেলে।  মানুষের যদি প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে যায়, তাহলে তাদের

উদ্দেশ্য সাধনের দিকে অগ্রসর হওয়া সহজ হবে। একারণেই মসজিদে নববীর মতো জায়গায়, শোলাকিয়া ঈদগাহের মতো জায়গায়, গুলশানের মতো জায়গায় কিছু নিরীহ বিদেশি উন্নয়নকর্মীকে টার্গেট


করে হত্যা করে, যাতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দ্রুত ছড়াতে পারে।

মানুষের মধ্যে দ্রুত এই সংবাদ ছড়িয়ে যায়। কিন্তু তারা এটা বোঝে না- দুইচারটে বোমা ফাটিয়ে, চারপাঁচজন মানুষ হত্যা করে- না কোনো সরকার পরিবর্তন করতে পারবে, না কোনো সমাজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারবে।

খ্যাতিমান এই ইসলামি চিন্তাবিদ আরও বলেন, আইএস, আলকায়েদা, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কিংবা জামায়াত-শিবির, এরা নামে ভিন্ন হলেও মৌলিকভাবে এদের চিন্তাচেতনা এক এবং অভিন্ন।  এই উপমহাদেশে প্রথম ইসলামের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা দেন- মাওলানা আবুল আলা মওদুদী নামে একজন সাংবাদিক।

উনি না আলেম ছিলেন, না সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তবে উনি মেধাবী ছিলেন। বিভিন্ন পুস্তুকে, তার একটা মাসিক পত্রিকা ছিল তার মধ্যে প্রচার করতে থাকেন। মানুষকে সংগঠিত করতে থাকেন। এবং ওই ফ্যাসিবাদী উগ্রদর্শনের ওপর একটা দল গঠন করেন, জামায়াতে ইসলামী নামে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোথাও তারা আইএসের নামে জঙ্গি হামলা চালাচ্ছে, কোথাও জামায়াত-শিবিরের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, কোথাও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে- এই যে জেমএবি বা বাংলাভাই, শায়খ আব্দুর রহমান এরা তো ছাত্রশিবিরেরই মানুষ।  তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে হতে পারে, কিন্তু গোষ্ঠী এক। এদের পেছনে মূল শক্তিদাতা হচ্ছে- জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জামায়াতে ইসলামী তরুণদের কিভাবে সম্মোহিত করেছিল। বিপথে নিয়েছিল, বিভ্রান্ত করেছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা, নিজামী, মুজাহিদের মতো তরুণদের মাথা খেয়েছিল এই জামায়াতে ইসলামী। কী করে এই সংগঠন বিবেকহীন করেছিল? এখনকার তরুণেরাও একই শিক্ষায় বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা বিভ্রান্তও। এদের পেছনে যারা পেছনে কলকাঠি নাড়ছে, নিঃসন্দেহে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মাসউদ বলেন, তরুণদের ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য, তাদের সচেতন করে তোলার জন্য পারিবারিক শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা এখন উগ্র-জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে, তার জন্য তরুণদের দোষ দিব না। তাদের ভুল পথে যাওয়ার পেছনে দুটি শ্রেণিকে দায়ী করব। প্রথম দোষ হচ্ছে, পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের কিংবা পারিবারিক ব্যর্থতা। সাড়ে তিন বা চার বছরের একটা বাচ্চার পিঠে একগাদা ইংরেজি বই চাপিয়ে দিয়ে চাচ্ছে- ইংরেজিতে হাসবে, ইংরেজিতে কাঁদবে, ইংরেজিতেই অন্যান্য কর্মকা-ও চালাবে! এই ছেলেটা তো নিজের মনকে খোলার জায়গা পাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ক্রটি রয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ তৈরি করতে দেয় না, এরা তো কিছু অবিবেচক, বিবেকবুদ্ধিহীন এক ধরনের রোবট তৈরি করছে! বাসার একটা টাইলস পাথর থেকে নেমে অপরিচিত পথ বেয়ে স্কুলে যায় একটা পাথরের মতো। এরা তো পাথর মানুষ হয়ে যাচ্ছে।

সংকটে সমাধান কী- পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের এখানে দায়িত্ব কতটুকু? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে জঙ্গিরা তাদের হামলাগুলো ধর্মের নামে পরিচালিত করছে। যেহেতু তারা ধর্মের নামে এসব করছে, ওদের এই ভুল পথ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পরিবারের দায়িত্ব অন্যতম। এছাড়া আলেম-ওলামা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকদের দায়িত্ব অপরিসীম।

রাষ্ট্র তার কলাকৌশল ব্যবহার করে কী করে ভুল পথে যাওয়াদের ফিরিয়ে আনা যায়, তা তারা ঠিক করবে। প্রয়োজনে কী করে তাদের কাউন্সিলিং করা যায়, তার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে আমরা যে ফতোয়া দিয়েছি, তাতে যে সমস্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত একটা করে ক্লাস করা উচিত। এটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শুধু পুলিশ দিয়েই জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদকে থামানো যাবে না বলেও মনে করেন খ্যাতিমান এই ইসলামী চিন্তাবিদ। -আমাদের সময়

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর