২০১৭ সাল যেভাবে কাটালেন খালেদা জিয়া

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ২০১৭ সালের শুরুর দিকটা বিএনপির অনেকটা ঘরমূখী থাকলে বছরের শেষ দিকে চমক দিখেছে দলটি। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য সফর, ১৮ মাস পর ঢাকায় সমাবেশ, খালেদায় জিয়ার আদালতে হাজিরা ও খালেদা জিয়ার কক্সবাজার সফর দলীয় নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত করেছে।

তবে এর আগে বছররের শুরু দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য বেশ কয়েকচার চেষ্টা করেছিল দলটি। কিন্তু প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়াতে তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ না করলেও দলটির প্রধান কার্যালয়, রাজধানীর বিভিন্ন হল রুম, জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দলটি।

খালেদার লন্ডন সফর:
২০১৭ সালে বিএনপি বড় ধরনের কোন কর্মসূচি পালন না করতে পারলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর করে আলোচনায় এসেছেন। চলতি বছরের ১৫ জুলাই চোখ ও পায়ের চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন বিএনপি প্রধান। সেখানে বড় ছেলে তারেক রহমানের বাড়িতে কোরবানির ঈদ উদযাপন করেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে চোখ ও হাঁটুর চিকিৎসা করান বিএনপি প্রধান।

এ ছাড়া দলের ভবিষ্যৎ, আগামী নির্বাচন নিয়ে মা-ছেলের মধ্যে কথা হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দুই নেতার সঙ্গেও বিএনপি প্রধানের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের খবরও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কয়েকজন ব্রিটিশ এমপির সঙ্গেও তার বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায়। পরে গত ১৭ অক্টোবর মধ্যরাতে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদায় জানান তার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন, তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান, মেয়ে জায়মা রহমান, আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শার্মিলা রহমান সিঁথি এবং তার দুই সন্তান। এ ছাড়া লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকসহ সহস্রাধিক নেতা-কর্মী বিমানবন্দরে ছুটে আসেন। এরপর খালেদা জিয়াকে বহন করা বিমানটি দুবাই এসে যাত্রাবিরতি করে ১৮ অক্টোবর বিকালে ঢাকার শাহজালা বিমানবন্দনে পৌঁছান খালেদা।

গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দীর্ঘ তিন মাস পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে রাজধানীতে শোডাউন দেয়া দলীয় নেতাকর্মীরা। তবে শোডাউনের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

বিমান বন্দর থেকে বের হওয়ার পর সড়কে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গাড়িতে থাকা খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান নেতাকর্মীরাও। বিমানবন্দরের বাইরে বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফ্যাস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। এ সময় বেগম জিয়াও গাড়ি থেকে হাত নাড়িয়ে নেতা-কর্মীদের অভিনন্দনের জবাব দিয়েছিলেন।এ সময় পুলিশও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল।

কক্সবাজার সফর:
লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পরই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কক্সবাজার সফর করেন। সেখানে গিয়ে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন তিনি।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে রাতে চট্টগ্রামে পৌঁছেন খালেদা জিয়া। সেখানে গিয়ে সার্কিট হাউজে রাত্রী যাপন করার পর পরদিন কক্সবাজারে পৌঁছেন। পরে উখিয়া ও টেকনাফ গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ত্রাণ বিতরণ শেষে ৩১ অক্টোবর সড়কপথেই তিনি ঢাকায় ফেরেন। তবে যাওয়ার পথে ফেনীতে খালেদার গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটে। আবার আসার সময়ও খালেদার গাড়ি বহরে হামলা ও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছিল।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশ:
২০১৭ সালের শুরুর দিকে থেকে সমাবেশ করার জন্য বার বার অনুমতি চেয়ে পায়নি বিএনপি। অবশেষে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে দলটি। ২৩ শর্তে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ। সমাবেশের অনুমতি পেয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দলে দলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিল। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রেখেছিলেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির আজকের সমাবেশ ঘিরে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ করেছিল বিএনপি।

বিএনপি নেতারা জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানী ঢাকামুখী বাস চলাচল আজ সকাল থেকে হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরে বিভিন্ন জেলা থেকে ছেড়ে আসা নাইট কোচগুলো রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে পারলেও সকাল থেকে দূরপাল্লার গাড়ি আসা প্রায় বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-মাওয়া পথে গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়। বিএনপির অভিযোগ, ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যাতে নেতাকর্মীরা আসতে না পারেন, তার জন্যই যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

আদালতে খালেদা:
চলতি বছরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২৩ দিন আদালতে গিয়েছেন। এ বছরর ৫ জানুয়ারি প্রথম হাজিরা দিতে আতালদে গিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর হাজিরা দিতে আদালতে গিয়েছিলেন খালোদা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার হাজিয়ার দিতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনায়ও এসেছেন তিনি। কারণ আদালতে যাওয়ার সময় ও বাসায় ফেরার সময় তিনি রাজপথে শোডাউন দিয়েছেন একাধিকবার।

তবে লন্ডন থাকাকালীন অবস্থায় মার্চ, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই চার মাসে তাকে আদালতে হাজিরা দিয়ে হয়নি।  আর ফেব্রুয়ারি, এপ্রিল ও মে মাসে একদিন করে তিনি হাজিরা দিয়েছেন। আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খালেদা জানুয়ারি তিন দিন, ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন, এপ্রিল মাসে একদিন, মে মাসে একদিন, জুন মাসে চার দিন, অক্টোবর মাসে দুই দিন, নভেম্বর মাসে চারতদিন ও ডিসেম্বর মাসে সাত দিন আদালতে গিয়ে হাজিরা দিয়েছেন।

সুষমা-খালেদার বৈঠক:
২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সাথে বৈঠক করেন বিএনপির-চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।ওই বৈঠকে ভারতও যে চায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরম্পরা অক্ষুণ্ণ থাক এবং সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন সম্পাদিত হোক, তা স্পষ্ট করা হয়েছে। ৪৫ মিনিটের ওই বৈঠকে  বিএনপি-র প্রতিনিধিদলে খালেদা জিয়া ছাড়াও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাবেক ক্যাবিনেট মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ছাড়াও পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা আলোচনায় অংশ নেন।

বৈঠকের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচনের বিষয়টি খালেদা জিয়া বৈঠকে তুলে ধরেছেন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেগুলো শুনেছেন।

তিনি (মিস স্বরাজ) আমাদের বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত প্রত্যাশা করে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও যাতে গণতন্ত্র বজায় থাকে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয় এবং নির্বাচন কমিশনও যাতে স্বাধীন ভাবে কাজ করে। আলমগীর আরও জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টিও তাদের আলোচনায় উঠেছিল এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে সরাসরি বলেছেন যে এই সঙ্কট নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। যারা বাংলাদেশে এসেছে তারা যেতে নিরাপদে দেশে ফেরত যেতে পারে সেজন্য তারা চাপ অব্যাহত রেখেছে এবং ভারত আশা করে তারা নিরাপদেই দেশে ফেরত যেতে পারবে”, মিস স্বরাজকে উদ্ধৃত করে জানান বিএনপি মহাসচিব।

তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর সাথে খালেদার বৈঠক:
বছরের শেষ মাসে আরেক সফলতা নিয়ে আসেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গত ১৯ ডিসেম্বর  বাংলাদেশ সফররত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদ্রিমের সাথে বৈঠক করবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বিষয়টি গণমাধ্যম বা দেশের সবার কাছে আলোচনার ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।  প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার ওই বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহউদ্দিন আহমেদ ও ইনামুল হক চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে দলটির পক্ষ থেকে ব্রিফিং করো হয়।

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন চলছে, আসন্ন নির্বাচনে কী অবস্থা দাঁড়াবে এবং নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা কী থাকবে—এসবের পাশাপাশি বর্তমানে সরকারের ভূমিকা কেমন আছে এবং দেশ কেমন চলছে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকার কী ভূমিকা পালন করছে তা নিয়েও কথা হয়েছে। এসব বিষয় ছাড়া তুরস্কের সঙ্গে পারস্পরিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তুরস্ক মনে করে যে, রোহিঙ্গাদের সসম্মানে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই বিষয়টির পুরোপুরিভাবে একটি স্থায়ী সমাধান করা প্রয়োজন বলে মনে করে তুরস্ক। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে তুরস্ক যোগাযোগ রক্ষা করছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, সে সমস্যাগুলোর সরেজমিনে দেখার জন্য। রোহিঙ্গাদের কীভাবে তাদের নিজ দেশে সম্মানের সঙ্গে, নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরত পাঠানো যায়—সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলতে তাঁরা এখানে এসেছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকেই তুরস্কের জনগণ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। রোহিঙ্গারা যেন তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে, সে জন্য তুরস্ক প্রথম থেকে কাজ করছে। এ কারণে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং তারপর বিষয়টি গোটা বিশ্বে নাড়া দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর