চিড়িয়াখানা গড়ে উঠেছে যেভাবে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জু মানে যে চিড়িয়াখানা এটা তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। যীশুখৃষ্টের জন্মেরও আগে চিড়িয়াখানা ছিল। কত আগে? খৃষ্ট জন্মেরও আড়াই থেকে দশ হাজার বছর আগে থেকে। মেসোপটেমিয়া, মিসর এবং চীনের মানুষ বুনো প্রাণীদের ধরে এনে খাঁচায় পুরে রাখত। আর তখন চিড়িয়াখানা কেবল পশু দেখার জন্যই ছিল না, এর সাথে জড়িয়ে ছিল একটা জাতির সম্মান, আনন্দ এবং বৈজ্ঞানিক কৌতূহল।

তখনকার দিনে প্রভাবশালী শাসকরা দূর দূরান্ত থেকে বুনো প্রাণী সংগ্রহ করতেন। যে শাসকের সংগ্রহে যত বেশি প্রাণী থাকত অন্যান্য শাসকদের কাছে তাদের সম্মানটাও তত বেশি হতো। শুধু তাই নয়, নিজের প্রজাদের কাছেও তত বেশি সমীহ আদায় করতে পারতেন তারা। আহা! অবলা বুনো প্রাণীদের দিয়েও তখনকার রাজা বাদশারা তাদের সম্মান ও সমীহ কিনতেন।

চিড়িয়াখানার গোড়াপত্তনের কথা বলতে গেলে প্রথমে মিসরীয়দের কথাই বলতে হয়। মিসরীয় রানী হাশেপসাট খৃষ্টপূর্ব ১৪৯০ অব্দে থেবসে একটি চিড়িয়াখানা স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। হাশেপসাটের চিড়িয়াখানার প্রাণীদের জোগাড় করা হয়েছিল সোমালিয়া থেকে।

কী কী ছিল সেই চিড়িয়াখানায়? সেটাও জানা গেছে। সেই চিড়িয়াখানায় ছিল বড় বড় গবাদি পশু, অদ্ভুত ধরনের পাখপাখালি, চিতাবাঘ, লেপার্ড, বানর এবং জিরাফ। মিসরের সম্রাট প্রথম টলেমি আলেকজান্দ্রিয়াতেও একটি চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এখানে বলে নেয়া ভালো যে, হেলেনিস্টিক যুগের সম্রাট প্রথম টলেমির শাসনকাল ছিল খৃষ্টপূর্ব আড়াইশ অব্দে। সম্রাট টলেমি প্রাণীদের ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী ছিলেন। টলেমির ছেলে সম্রাট দ্বিতীয় টলেমি এই চিড়িয়াখানাকে আরো সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি আরো নানান জাতের নানান ধরনের প্রাণী সংগ্রহ করিয়েছিলেন।

খৃষ্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে এই চিড়িয়াখানার অধিবাসী কোন ধরনের প্রাণী ছিল, তার খোঁজও পাওয়া গেছে। ওই চিড়িয়াখানায় তখন ৯৬টা হাতি, ২৪ টা সিংহ, ১৪টা লেপার্ড, ১৬টা চিতাবাঘ, ১৪টা উট, একটি জিরাফ, একটি গণ্ডার, প্রায় একশটি পোষা প্রাণী ছিল। এসব পোষা প্রাণীর মধ্যে নানান জাতের পাখিও ছিল।

এবার মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন কালের চিড়িয়াখানার সম্পর্কে কিছু জানা যাক। মেসোপটেমিয়ার সুমারিয়া, ব্যাবিলন এবং আসিরিয় রাজাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা চিড়িয়াখানা ছিল। এসব চিড়িয়াখানা ছিল রাজাদের ক্ষমতা, সম্পদ এবং প্রতিপত্তির প্রতীক। কাজেই মেসোপটেমিয়ার রাজারা তাদের চিড়িয়াখানা নিয়ে গর্ব করতেন।

তবে মেসোপটেমিয়ার রাজাদের মধ্যে সুমেরিয়ার রাজা শুলগি সবার আগে চিড়িয়াখানা স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়। রাজা শুগলির রাজত্বকাল ছিল খৃষ্টপূর্ব ২০৯৪ থেকে ২০৪৭ অব্দ পর্যন্ত। তার সংগ্রহে ছিল অনেক ধরনের সিংহ।

আসিরিয়ার রাজা প্রথম টিগালার পিলসারের (খৃষ্টপূর্ব ১১১৪ থেকে ১০৭৬ অব্দ) সংগ্রহে ছিল হরিণ, গজলা হরিণ এবং আইবেক্স নামের এক ধরনের বুনোছাগল। আসিরিয়ার রাজা দ্বিতীয় আশুরনাসিরপলের (খৃষ্টপূর্ব ৮৮৩ থেকে ৮৫৯ অব্দ) সংগ্রহে ছিল বুনো ষাঁড়, সিংহ, উটপাখি এবং উল্লুক। আর আসিরিয়ার রাজা দ্বিতীয় সারজনের (খৃষ্টপূর্ব ৭২১ থেকে ৭০৫ অব্দ) পছন্দের প্রাণীদের মধ্যে ছিল সিংহ এবং বাজপাখি। ব্যাবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাডরেজারও (খৃষ্টপূর্ব ৬৬৮ থেকে ৬২৭ অব্দ) বুনো প্রাণী সংগ্রাহক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন।

প্রাচীন চীনেও বুনো পশু-পাখি সংগ্রহের প্রচলন ছিল। খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে শ্যাং রাজবংশের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই চীনের শাসকরা চিড়িয়াখানা স্থাপন করা শুরু করেন। চীনা সম্রাজ্ঞী টানকি হরিণের ঘর নামে পাথরের তৈরি একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ করিয়েছিলেন।

সম্রাজ্ঞী টানকি খৃষ্টপূর্ব ১১৫০ অব্দের সময়কালে রাজত্ব করতেন। ঝো রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ওয়েন ওয়াঙ বিশাল একটি পশুসংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঝো রাজবংশ চীন শাসন করেছিল খৃষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ২০০ অব্দ পর্যন্ত। চীনারা এই পশুসংগ্রহশালাকে বলত লিঙইউ।

মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্য, অঙ্গরাজ্য এবং লোকালয়ে পশুসংগ্রহশালাও গড়ে ওঠে। আধুনিক বিশ্বের শুরুর দিকে, অ্যাজটেক সম্রাট দ্বিতীয় মন্টেঝুমা টেনোখিটলানে (বর্তমান নিউ মেক্সিকো) একটি পশু সংগ্রহশালা স্থাপন করেছিলেন।

এখানে ভিন্ন ভিন্ন ভবন, খাঁচা, বাগান, হ্রদ, ঝরণা এবং পুকুর বানানো হয়েছিল এসব পশুর আবাসস্থল হিসেবে। এ চিড়িয়াখানায় ছিল পাখি, স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। তবে দিন যত গড়িয়েছে চিড়িয়াখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যও তত পরিবর্তিত হয়েছে।

এখন আর চিড়িয়াখানা কেবল দেখার জন্য নয়। প্রভাব, প্রতিপত্তি, বিত্ত কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যও নয়। এখন পশুপাখি নিয়ে গবেষণার জন্যও চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। চিড়িয়াখানার অর্থ এখন- প্রদর্শন, বিনোদন ওগবেষণার জন্য জীবন্ত প্রাণী রাখার সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যান।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, ১৮০১ সাল থেকে শুরু করে কলকাতায় চারটি বন্যপ্রাণী সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৮৫৪ সালে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুর কলকাতার চোরবাগানে প্রতিষ্ঠা করেন মার্বেল প্যালেস জু। এখনও ওই চিড়িয়াখানাটি কলকাতায় আছে।

জনসাধারনের শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য সচেতন রাজা রাজেন্দ্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগ্রহশালায় ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী এনে রাখা হয়েছিল।

ঢাকার চিড়িয়াখানা:

ঢাকার নবাবদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে পশুপাখি পালতেন। শুধু নবাবরাই নন, ঢাকার অনেক অবস্থাসম্পন্ন মানুষই পশুপাখি পুষতেন। সে সময় রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে গেলে বন্য প্রাণী উপহার পেতেন। এসব বুনো প্রাণীদের কেমন করে পুষতে হয়, সে সম্পর্কে সঠিক ধারনা বা জ্ঞান সবার ছিল না। কাজেই অনেকে তখন সরকারিভাবে এদের রাখার ব্যবস্থার আবেদন জানালেন। ৯৫০ সালে হাইকোর্ট সংলগ্ন রমনা পার্কে কয়েকটা ঘর তুলে এদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময় ওই চিড়িয়াখানায় ছিল ৩/৪টা চিতাবাঘ, কয়েকটা ময়ূর, দেশি-বিদেশি পোষা পাখি, বাঘডাস, মেছোবাঘ, কুমির, বনবিড়াল ও শেয়াল। ঢাকার প্রথম চিড়িয়াখানাই ছিল এটা।

ষাটের দশকে ঢাকার মিরপুরে মানসম্পন্ন চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। প্রথমে ২১৩.৪১ একর জমি নিয়ে চিড়িয়াখানা হলেও পরে এর আয়তন দাঁড়ায় ১৮৬.৬৩ একর। ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন মিরপুর চিড়িয়াখানা জনগনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

মিরপুর চিড়িয়াখানায় এখন প্রায় ১৯০ প্রজাতির প্রায় ২ হাজার ২ শ প্রাণী আছে। অক্টেবর থেকে মার্চ পর্যন্ত চিড়িয়াখানা খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। আর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিড়িয়াখানা খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত। রোববার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে।

মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই চিড়িয়াখানাটি বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা। ঢাকার মিরপুর ছাড়াও রংপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা ও খুলনা শহরে আরো পাঁচটি চিড়িয়াখানা আছে।

আগেই বলা হয়েছে, এখন চিড়িয়াখানা কেবল পশুপাখি প্রদর্শন নয়, আরো অনেক কাজ হয়। পশুপাখির চরিত্র, প্রকৃতি, চিকিৎসা, গবেষণাসহ নানান ধরনের কাজ। চিড়িয়াখানার আদলেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। নানান ধরনের চিড়িয়াখানা গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। যেমন বায়োপার্ক, সাফারি পার্ক, ওপেন রেঞ্জ জু, অ্যানিমেল থিম পার্ক, রোডসাইড জু, পেটিং জু, স্পেশালাইজড জু ইত্যাদি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর