গিবত কখন বৈধ হয়

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে গিবত করা হারাম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গিবত করা বৈধ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে গিবত করা শুধু বৈধই নয়, পুণ্যেরও কাজ বটে। ইমাম নববি, আল্লামা ইবনে আবিদিন শামী ও আবদুল হাই লাখনাবি তেরোটি ক্ষেত্রে গিবত করা বৈধ মনে করেছেন।

১. কোনো ব্যক্তি বিচারক, মুফতি, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বা পদস্থ কর্মকর্তার জুলুমের শিকার হলে সে তার প্রতিকারের জন্য রাজদরবারে নালিশ করতে পারবে। এরূপ জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে গিবত বা নালিশ করা বৈধ। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ খারাপ ব্যাপারটি বলুক তা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার ওপর জুলুম হয়েছে তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র।’

২. কোনো ব্যক্তি যদি পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে তাকে পাপাচার থেকে বারণ করতে উপদেশ দিতে কিংবা সংশোধনের জন্য গিবত করা জায়েজ আছে। কুফার গভর্নর সাদ (রা.) এর বিরুদ্ধে খলিফা ওমর (রা.) এর কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করা হলো যে, তিনি ভালো করে নামাজ পড়েন না এবং যথাযথভাবে কোরআন পাঠ করেন না। ওমর (রা.) অভিযোগের ভিত্তিতে সাদ (রা.) কে গভর্নর পদ থেকে বরখাস্ত করে তদস্থলে হজরত আম্মার (রা.) কে গভর্নর নিয়োগ করলেন। অতএব বোঝা যায়, জালিম শাসকের কিরুদ্ধে নালিশ করা, যা গিবতের মতো দেখায়, জায়েজ আছে।

৩. লজ্জা দিয়ে পাপাচার থেকে বিরত রাখার জন্য গিবত করা বৈধ। এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) এর কাছে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে রাসুল (সা.) বললেন, তোমার ঘরের জিনিসপত্র রাস্তায় এনে রেখে দাও। এমন নিরব প্রতিবাদ দেখে তোমার প্রতিবেশী লজ্জিত হয়ে তোমাকে কষ্ট দেওয়া ত্যাগ করবে। রাসুল (সা.) এর কথা মতো মালপত্র রাস্তায় ফেললে লোকরা রাস্তা অতিক্রম করার সময় তাকে মালপত্র রাস্তায় নিক্ষেপের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, প্রতিবেশী তাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রতিবেশীর কাছে এ খবর পৌঁছলে সে লজ্জিত হয় এবং প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমা চায়।

৪. কোনো বিজ্ঞ আলেমের কাছে মাসালা জানার জন্য কারও দোষ বর্ণনা করা জায়েজ আছে। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা রাসুল (সা.) এর কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে এভাবে গিবত করল যে, তিনি খুব কৃপণ এবং স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ-পোষণ ঠিকমতো প্রদান করেন না। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি তার অজান্তে সন্তানদের ভরণ-পোষণের আন্দাজ প্রয়োজনীয় মাল নিয়ে নাও।

৫. প্রয়োজনীয় উপদেশ ও সংশোধনের জন্য গিবত করা যায়। মহানবী (সা.) এর কাছে সাহাবায়ে কেরাম লোকদের দোষত্রুটি বর্ণনা করতেন। তবে মুসলমানদের অপমান করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না বরং উদ্দেশ্য ছিল যাতে মহানবী (সা.) তাদের নসিহত করেন এবং তারা সংশোধন হয়ে যায়।

৬. প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির সম্পর্কে গিবত করা জায়েজ। যেমন বেনামাজি, মদ্যপায়ী ও স্বৈরাচারী শাসকের গিবত করা। আল্লাহর কাছে এ ধরনের ব্যক্তির কোনো মর্যাদা নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন পাপাচারী ফাসেকের প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।

৭. কোনো ব্যক্তি দ্বারা যদি অপর কোনো ব্যক্তি তার অজান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার গিবত করা যাবে, যাতে সে অন্য লোকের ক্ষতির কারণ না হয়। যেমন কোনো ব্যক্তি এর কথা ওর কানে এবং ওর কথা এর কানে দিয়ে মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে, এ অবস্থায় তার গিবত করা জায়েজ আছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত থাকলে এবং তার দ্বারা অপরের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে সে ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ নেই। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, কোনো বান্দা দুনিয়ার অপর কোনো বান্দার দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন সে বান্দার দোষ গোপন করে রাখবেন।

৮. কেউ যদি নিলর্জ্জভাবে প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং তাকে কেউ সতর্ক করলেও তার প্রভাব তার ওপর পড়ে না, এমন ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ। এ কারণে সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.) এর কলিজার টুকরা হজরত হুসাইন (রা.) এর হত্যাকারীদের গিবত করতেন এবং তাদের ভর্ৎসনা করতেন। কেননা তারা নির্লজ্জ ও বেহায়া ছিল। শেখ সাদি (রহ.) তিন ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ মনে করেন। তারা হচ্ছে বেহায়া, স্বৈরাচারী শাসক ও যার পাপাচার অন্যের ক্ষতির কারণ হয়।

৯. দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশের নিমিত্তে কারও গিবত করা যায়। যেমন কেউ যদি আফসোস করে বলে যে, অমুক নামাজ পড়ে না, রোজা রাখে না, জাকাত প্রদান করে না, আত্মীয়ের হক আদায় করে না তবে তা গিবত হবে না। এরূপ খারাপ কাজে আফসোস করা উত্তমও বটে।

১০. কেউ যদি বিশেষ কোনো খারাপ উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয় এবং সেই খারাপ উপাধি উল্লেখ করা ব্যতীত পরিচয় দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে এক্ষেত্রে খারাপ উপাধি উল্লেখ করা যাবে, এতে গিবত হবে না। যেমন কাউকে বিকলাঙ্গ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তবে এরূপ উপাধি পরিহার করা উত্তম।

১১. কোনো ব্যক্তির সরাসরি নাম উল্লেখ না করে গিবত করা জায়েজ আছে। ১২. ইসলামকে শক্তিশালী তথা বিজয় করার লক্ষ্যে গিবত করায় কোনো দোষ নেই। যেমন হাদিস বিশারদরা হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বর্ণনাকারীদের কখনও মিথ্যাবাদী, তার স্মৃতিশক্তি প্রখর নয়, তিনি প্রত্যাখ্যাত ইত্যাদি বলেছেন। এভাবে বলা গিবত নয়।

১৩. মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য জীবিত কিংবা মৃত ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ আছে। যেমন জীবিত ব্যক্তি সম্পর্কে অমুক জাহান্নামের উপযোগী কাজ করছে, কেননা সে বড়ই কৃপণ। অথবা কোনো মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারে বলা যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে স্বপ্নে শাস্তি ভোগ করতে দেখেছি। অতএব বলা যায়, গিবত একটি নিষিদ্ধ চর্চা হলেও প্রয়োজনে তথা শরিয়তের সীমারেখার মধ্য থেকে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা ব্যতীত সতর্কতা, সংশোধন ও প্রয়োজনীয়তা জ্ঞান প্রদানের জন্য গিবত করা জায়েজ আছে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর