ঘুষকে ভিক্ষুকের আহার মনে করি

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আজ এই দিনে ২৫ বছর আগে ১৯৯৩ সনের ১ এপ্রিল আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। জনগণের করের টাকা বেতন হিসেবে পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি। টেনেটুনে সংসার চালিয়েছি ২৩টি বছর। আমার সংসার চালানোর ইতিহাস লেখা হলে আমার পরিবারের সদস্যরা যতটুকু লজ্জা পাবে তার চেয়ে বেশি লজ্জা পাব আমি। তাই কষ্টের অধ্যায় নিয়ে আর কিছু লিখলাম না।

সরকারি চাকরিতে ঘুষের বিষয়টি মনে হয়েছিল অপরিহার্য ব্যাপার। জেলা উপজেলায় চারিদিকে শুধু ঘুষের গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমি ঘুষকে ভিক্ষুকের আহারের সাথে তুলনা করি। আট বছর অর্থবিভাগে কাজ করার সময় আমাকে কেউ ভিক্ষা দিতে চায়নি। কিন্তু চাকরির বাকি সময় আমাকে শুধু একটি প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছে আর সেটি হচ্ছে, আমি কেন ভিক্ষার টাকা নেই না। আমি একটি উত্তর দিয়ে থাকি এভাবে যে, আমার বাবা ভিক্ষা করতে শিখায়নি তাই নিতে পারি না।

এসকল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমি এ সমাজকে কী দিতে পারছি তার হিসেব মিলিয়ে দেখা দরকার। আজ কেন জানি মনে হল একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে থাকাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় হতে পারিনি। বন্ধুরা বলত বিসিএস পরীক্ষা দিলে আমি সরকারি চাকরি পেয়ে যাব। এ চাকরিতে এসে প্রথম গেলাম পাবলিক পরীক্ষার হলে। পরীক্ষার হলে যে দৃশ্য আমি দেখেছি তা আজও ভাবলে অবাক হয়ে যাই। দেখলাম প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী নকল করছে আর শিক্ষকগণ অসীম দক্ষতায় তাদের সহযোগিতা করছে। আমার জীবনে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এমনকি অনেক শিক্ষক বহিষ্কার করেছি। উদ্দেশ্য ছিল এই প্রয়াসের মাধ্যমে যদি একটু সমাজের পরিবর্তন আনতে পারি। অবশ্য এর জন্য কোন কোন সিনিয়র অফিসারের বিরাগভাজন হতে হয়েছে অনেক বার। এখন আমার ছেলে যখন বলে, ‘পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষিক প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়’ তখন ভাবতে থাকি আমি কি না বুঝে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জীবন নষ্ট করেছিলাম।

১৯৯৮ সনে সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভালুকায় প্রায় ৩০০ একর জায়গায় হাজার ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করেছিলাম এবং এ কারণে আমার বিরুদ্ধে অবৈধ দখলদারেরা ১৫টি দেওয়ানি মামলা করেছিল। মনে পড়ে এ প্রকল্পের ডিজি এবং ইউএনও এলাকা ও লোকজন দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন তোমার এই প্রকল্প মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখলে খুব খুশি হবেন। ডিজি সাহেব বাংলাদেশে ভূমিহীনদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্বোধন করেন ভালুকা উপজেলায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র ভাইয়ের বৈধ মিউটেশনের বিনিময়ে তিন ট্রাক গাছের চারা আশ্রয়ন প্রকল্পের জন্য নিয়েছিলাম। গণশিক্ষার বিস্তারের আশায় তিন মাসে ভালুকায় জাগ্রত ময়মনসিংহের ২২০০টি গণশিক্ষা কেন্দ্র রাতের অন্ধকারে মটরসাইকেলে করে পরিদর্শন করেছি। প্রতিটি কেন্দ্রে লেকচার দিয়েছি। টিএনও সাহেব একদিন আমায় বললেন লোকাল পেপারে তোমার একটি বক্তব্য ছাপিয়েছে। আমি পেপারটি আনিয়ে দেখলাম সেখানে ব্যানার হেডিং এ লিখা, ‘আমি স্বপ্ন দেখি রিকশা চালকেরা তাদের অবসর সময়ে সিটে বসে খবরের কাগজ পড়ছে’।

আমার মনে পড়ে ইউএনও অফিস চত্বরে আমি নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাজার রিকশা চালককে হাজির করিয়েছিলাম যেখানে জেলা প্রশাসক দুই ঘণ্টা শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। শিক্ষা কেন্দ্রে না আসায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অনেক বয়স্ক লোকের চুল কেটেছি। আমাকে দেখে চুল কাটার বা থানায় যাওয়ার ভয়ে অলস লোকজন শিক্ষা কেন্দ্রে যেত। জেলা প্রশাসক কাজ দেখে আমার বাসায় এসে উৎসাহ দিতেন আবার আমার মত একজন ছোট অফিসারের নিকট হতে পরামর্শ নিতেন। জেলা প্রশাসক জাগ্রত ময়মনসিংহের সমাপনি দিনে একটি চিরকুট আমায় দিয়েছিলেন তাতে লিখা ছিল- ‘যাদের দেখার কেহ নেই তাদের জন্য তুমি আছ’। চিরকুটটি ছিল আমার চাকরি জীবনের অনুপ্রেরণার একটি অনুঘটক। অনেক কথাই মনে পড়ছে – আজ এ পর্যন্ত।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর