কিশোরগঞ্জ ৬ নাজমুল হাসান পাপন ও শরীফুল আলম দুই হেভিওয়েটের লড়াই

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জ জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ভৈরব উপজেলা এবং ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার খ্যাত কুলিয়ারচর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-৬ নির্বাচনী এলাকা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা দেশের মতো এ আসনেও বইছে ভোটের হাওয়া। তবে এ আসনে দলীয় প্রার্থী নিয়ে যতটা না আলোচনা, তার চেয়ে বেশি আলোচনা ভোটের ইস্যু নিয়ে। কারণ, বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র দলীয় মনোনয়ন অনেকটাই চূড়ান্ত।

এখানে বর্তমান সংসদ সদস্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের ছেলে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে আওয়ামী লীগের এবং কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি সভাপতি মো. শরীফুল আলমকে বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন এলাকাবাসী। আর এই দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে ঘিরেই চলছে হিসাব-নিকাশ।

যদিও ভৈরব শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইফতেখার হোসেন বেনু আওয়ামী লীগের এবং ভৈরব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী মো. গিয়াস উদ্দিন বিএনপি’র মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন।

ভৈরব উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়ন এবং কুলিয়ারচর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ’৭৩ সালের ৭ই মার্চ, ’৮৬ সালের ৭ই মে, ’৯৬ সালের ১২ই জুন, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর ও ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাঁচবার এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ বয়কট করে। ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র মজিবুর রহমান, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আবুবকর সিদ্দিক, ১৯৯১ সালে বিএনপি’র আবদুল লতিফ ভূঁইয়া এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি’র মো. শফিকুল ইসলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাজমুল হাসান পাপন। তবে এর আগে ২০০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিল্লুর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এ আসনে ৩রা এপ্রিল উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপ-নির্বাচনে প্রেসিডেন্টপুত্র নাজমুল হাসান পাপন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ২৯ হাজার ১৪৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৮ জন এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৮০ জন। উপজেলাওয়ারী হিসাবে ভৈরব উপজেলার মোট ভোটার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪০ জন এবং কুলিয়ারচর উপজেলার মোট ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ৩০৮ জন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ আর প্রচারণায় এ আসনে ভোটযুদ্ধের আগাম তৎপরতা বেশ জোরেশোরেই এগিয়ে চলেছে। স্থানীয়দের মাঝেও চলছে এ নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের বিপক্ষে চারদলীয় জোট প্রার্থী হিসেবে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হন বিএনপি নেতা আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরীফুল আলম। ওই নির্বাচনে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চারদলীয় জোট প্রার্থী মো. শরীফুল আলম পেয়েছিলেন ৮৯ হাজার ৮৩৭ ভোট। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ৩রা এপ্রিল অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মো. শরীফুল আলম। উপ-নির্বাচনে প্রেসিডেন্টপুত্র নাজমুল হাসান পাপন ১ লাখ ৬ হাজার ১৩৭ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতা মো. শরীফুল আলম ৬৮ হাজার ৩২৭ ভোট পান। ওই নির্বাচন থেকেই মূলত এ আসনে নাজমুল হাসান পাপন এবং মো. শরীফুল আলমের রাজনৈতিক দ্বৈরথ শুরু হয়। নাজমুল হাসান পাপনের নিজ উপজেলা ভৈরব এবং মো. শরীফুল আলমের নিজ উপজেলা কুলিয়ারচর। এই আসনের দুই উপজেলা থেকে দুই প্রধান দলের প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় দলীয় হিসাবের বাইরে নির্বাচনে আঞ্চলিকতাও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, সংগঠন হিসেবে এ আসনে আওয়ামী লীগের রয়েছে সুদৃঢ় ভিত্তি ও সংহত অবস্থান। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের হাত ধরে এখানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিকশিত হয়। এছাড়া তাঁর সহধর্মিণী একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভী রহমানের অনন্য ভূমিকায় এখানে শক্ত গণভিত্তি পায় দলটি। দলীয় এই অবস্থান এবং পারিবারিক ঐতিহ্য রাজনীতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছে নাজমুল হাসান পাপনকে। পিতার সুবিশাল অনুগত কর্মীবাহিনী সহজ করে দিয়েছে তার রাজনীতির গতিপথ।

এরপরও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গ্রুপিংয়ে বেকায়দায় রয়েছেন নাজমুল হাসান পাপন। তার বিপক্ষে মনোনয়ন দৌড়ে সরব রয়েছেন ভৈরব শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইফতেখার হোসেন বেনু। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর বলয় প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আসছেন ইফতেখার হোসেন বেনুকে।

স্থানীয়রা বলছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গ্রুপিং এবং একটি গ্রুপকে দল থেকে মাইনাস ফর্মুলা এই মনোনয়ন জটিলতার পথ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে এরই মধ্যে তৃণমূলের ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে আলহাজ নাজমুল হাসান পাপন বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি জনসভা করেছেন। এসব জনসভায় ‘নৌকা, নৌকা’ স্লোগানে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে যোগ দেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। কিন্তু, মিছিল ও জনসভায় ইফতেখার হোসেন বেনু পিছিয়ে থাকলেও থেমে নেই তার তৎপরতা।

তবে দলে কোন্দল-গ্রুপিং যাই থাক না কেন আগামী নির্বাচনে নাজমুল হাসান পাপন-ই যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন, এ নিয়ে সংশয় নেই কারো। স্থানীয়রা জানান, সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপনের একটি পরিচ্ছন্ন ইমেজ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তিনি একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের পুত্র হিসেবেও এলাকায় তার একটি আলাদা ও সংহত অবস্থান রয়েছে। এছাড়া বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকেও স্থানীয়রা যথেষ্ঠ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। এসব নানা কারণে এ আসনে নাজমুল হাসান পাপন কেবল একজন শক্তিশালী প্রার্থীই নন, ভিআইপি প্রার্থীও।

অন্যদিকে জেলা বিএনপি’র বর্তমান সভাপতি মো. শরীফুল আলম আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। এ আসনে মো. শরীফুল আলমের ব্যক্তি ইমেজই বিএনপিকে এগিয়ে রেখেছে। তার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আসনটি দখলে নিতে মরিয়া বিএনপি। নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করতে নেতাকর্মীদের সঙ্গী করে মাঠপর্যায়ে সরব রয়েছেন শরীফুল ইসলাম। দলীয় কর্মসূচি পালন ও সাংগঠনিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দফায় দফায় হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন তিনি। যেতে হয়েছে কারাগারেও। এরপরও হতোদ্যম না হয়ে নেতাকর্মীরা স্বপ্ন দেখছেন শরীফুল আলমকে নিয়ে।

যদিও এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাপ্রকাশ করছেন ভৈরব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মো. গিয়াস উদ্দিন। মো. শরীফুল আলমকে দিয়ে এই আসনটি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় বাধা মনে করা হচ্ছে দলের সমর্থন ও প্রতীক ছাড়াই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া মো. গিয়াস উদ্দিনকে।

তবে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের ভাষ্য, এ আসনে বিএনপিতে শরীফুল আলমের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিকে তিনি সাংগঠনিকভাবে এ আসনে যথেষ্ঠ সংহত অবস্থানে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছেন। সরকার ও প্রশাসনের বৈরী আচরণের মুখে যেভাবে তিনি দলীয় কর্মসূচি পালনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনটি এখন সচরাচর দেখা যায় না। হেভিওয়েট এই প্রার্থীর মাধ্যমেই আগামী নির্বাচনে আসনটি বিএনপি’র দখলে আসবে বলেও তারা আশাপ্রকাশ করছেন।

সাধারণ ভোটারদের মতে, জেলার সবচেয়ে আলোচিত এই আসনটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’দলেরই প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরাবরের মতোই আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে তৎপর আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুর্গে আঘাত হানতে মরিয়া বিএনপি। এ অবস্থায় দু’দলের দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াইয়েরই আগাম ধারণা দিলেন স্থানীয়রা।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর