ফজরে উঠতে পারছেন না? আপনার জন্য ৭ পরামর্শ

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জীবনে কতবার আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফজরের নামাযের সময় পার করেছেন? কতবার এমন হয়েছে যে, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও অলসতায় আর পাঁচ মিনিট চিন্তা করে চোখ বুজে থাকা, অতঃপর পুনরায় চোখ মেলে দেখতে পেলেন সূর্যোদয় অনেক আগেই হয়ে গেছে এবং ফজরের নামাযের সময় পার হয়ে গেছে? আমার ধারণামতে, অসংখ্যবার। কেননা এই বিষয়গুলো আমাদের অনেকেরই জীবনে একই রকম সাদৃশ্যপূর্ণ।

ফজরের নামাযের জন্য ঘুম থেকে উঠা প্রকৃতপক্ষেই একটি প্রয়াসসাধ্য কাজ। রাসূল (সা.) বলেছেন,

“তোমাদের ঘুমের সময় শয়তান তোমাদের মাথার পেছনে তিনটি গিট বাঁধে এবং তোমাদের উপর নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘রাত অনেক দীর্ঘ, সুতরাং ঘুমাতে থাকো।’ যদি কেউ ঘুম থেকে ওঠার পর আল্লাহর প্রশংসা আদায় করে, তখন তার একটি গিট খুলে যায়। যখন সে ওযু করে, দ্বিতীয় গিটটিও খুলে যায় এবং যখন সে নামায আদায় করে, তখন তৃতীয় গিটটিও খুলে যায়। এর মাধ্যমে সে পূর্ণ প্রশান্তি ও প্রফুল্লতার সাথে তার দিন শুরু করতে সক্ষম হয়। অন্যথায় বিষণ্ণতা ও অবসন্নতার সাথে তার দিনের সূচনা হয়।” –বুখারী

ফজরের নামাযের মাধ্যমে দিনের সূচনা করে আমরা আল্লাহর অপরিসীম রহমত অর্জনে সক্ষম হই। কেননা ইসলামে ফজর নামাযের অনন্য গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে।

যখন দুনিয়ার সকলেই ঘুমিয়ে থাকে, আল্লাহ তখন তার সেই বান্দাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যারা তাদের ঘুমকে কুরবানী করে নামাযে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ায়।

দুনিয়ার যাবতীয় কোলাহল এবং ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত হয়ে প্রশান্তিকর এই সময়ে তখন আল্লাহ এবং তার বান্দার মধ্যে কোন কিছুর প্রতিবন্ধকতা থাকে না।

রাসূল (সা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে আল্লাহ নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং তার বান্দাদের তার কাছে ক্ষমা এবং প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনার জন্য আহবান জানাতে থাকেন।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন,

“প্রতি রাতের শেষ এক তৃতীয়াংশে আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী সর্বশেষ আসমানে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেন, ‘কে আছো আমাকে আহবানকারী, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছো আমার কাছে ফরিয়াদ করার, আমি তার প্রয়োজন পূরণ করবো। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার, আমি তাকে ক্ষমা করবো।” –বুখারী

অবশ্য ফজরের সময় ওঠা আমাদের অধিকাংশের জন্যই কষ্টকর। আরামের ঘুম ছেড়ে নামাযের জন্য দাঁড়ানো প্রকৃতপক্ষেই নিজের সাথে এক বিশাল সংগ্রামের বিষয়। যেহেতু আমরা সকলেই মানুষ হিসেবে জৈবিক চাহিদার অধিকারী, অনেকক্ষেত্রেই তাই আমাদের আধ্যাত্মিক চাহিদার তুলনায় জৈবিক নিদ্রার চাহিদা বিশেষ করে ফজরের সময়ে আমাদের উপর চেপে বসে।

যদি আপনার ফজরেরর নামায সঠিক সময়ে বারবার ব্যর্থ হন এবং এর মাধ্যমে নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকেন, তবে একে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি উপহার মনে করতে পারেন যার মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে তার সাথে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করার জন্য সুযোগ প্রদান করছেন।

এখানে ফজরের সময় ঘুম ছেড়ে ওঠে নামায আদায় করতে পারার জন্য ছয়টি পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

১. নিজেকে আশ্বস্ত করুন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করছেন 

প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন আপনি কেন ফজরের সময় উঠতে চাচ্ছেন। আপনি শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্যই এই কষ্ট করতে চাচ্ছেন। যদি কয়েক মিনিটের ঘুম ত্যাগ করে আল্লাহর সামনে আপনি দাঁড়াতে না পারেন, তবে আল্লাহ কি করে দুনিয়ার বিশাল পরীক্ষা এবং আখেরাতে ধৈর্য্য ধারণ করার শক্তি আপনাকে দান করবেন? আমরা কি করে তার রহমতের প্রত্যাশা সেই কঠিন বিচারের দিনে করতে পারি, যদি আমরা আমাদের দুনিয়ার ঘুমের কয়েক মুহূর্ত কোরবানী করতে না পারি?

২. ফজরের পুরস্কারসমূহ স্মরণে রাখুন

প্রতিটি রাতেই, ফজরের নামায আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে ঘোষিত পুরস্কারের কথা স্মরণে রাখুন। এতে করে ফজরে ঘুম ছেড়ে উঠার জন্য আপনি নিজ মনে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।

ফযিলত সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীসের ভাষ্য নিম্নরূপ,

“যে ফজর এবং আসর, উভয় নামায আদায় করতে পারলো, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” –বুখারী

“যে ব্যক্তি ফজরের নামায আদায় করলো, সে আল্লাহর নিরাপত্তার আওতায় প্রবেশ করলো। হে আদম সন্তান! সতর্ক হও, নতুবা আল্লাহ তোমাদের তার নিরাপত্তা আচ্ছাদন তোমাদের থেকে উঠিয়ে নিতে পারেন।” (মুসলিম)

“যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে নামায আদায় করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম)

৩. দৃঢ় অভিপ্রায়

ফজরের নামায আদায়ে ঘুম থেকে উঠার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর, আপনার নিজের মধ্যে দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করা উচিত এবং আপনার সাধ্যমতো সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত যাতে করে আপনি ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠতে পারেন।

সচেতনভাবে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ফজরকে গুরুত্বের সাথে অর্ন্তভুক্ত করার চেষ্টা করা প্রয়োজন, যেভাবে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজ সচেতনভাবে গুরুত্বের সাথে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন। যদি আপনি আপনার জীবনে ফজরকে গুরুত্বের সাথে নিতে না পারেন, তবে আপনার বাকী সকল প্রচেষ্টাই বৃথা হয়ে যেতে পারে। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় ঘুম থেকে উঠার জন্য দৃঢ় অভিপ্রায় নিয়ে ঘুমান।

৪. আন্তরিক দোয়া

ঘুমানোর পূর্বে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ফজরের সময় উঠার জন্য প্রার্থনা করুন। আপনি যদি আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করতে পারেন, তবে তিনি কখনোই আপনাকে হতাশ করবেননা। আপনি বরং বিস্মিত হবেন, আপনার দোয়ার ফল কি করে আপনার অ্যালার্ম ঘড়ির থেকেও কার্যকর হতে পারে।

৫. অ্যালার্মের স্নুজ অপশন ডিজেবল করে রাখা

আপনি আপনার নিজের জন্য একটি উপকার করুন এবং তা হলো, আপনার ফোন, ট্যাবলেট বা ঘড়ির অ্যালার্মের স্নুজ বাটনটি ডিজেবল করে রাখুন।

যদি আপনার ঘড়ির অ্যালার্মে স্নুজ অপশন না থাকে, তবে হয় আপনি ঘুম থেকে উঠে যাবেন অথবা অ্যালার্ম বন্ধ করে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়বেন।

এ প্রক্রিয়ায় আপনি হয় আপনার অ্যালার্ম সম্পর্কে পূর্ণভাবে অচেতন হয়ে ঘুমাবেন অথবা অ্যালার্মের সাথে সাথে সজাগ হয়ে যাবেন।

৬. রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করা

আপনি যদি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান, তবে স্বাভাবিকভাবেই সকালে ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে পারবেন। যার মাধ্যমে আপনি সহজেই নামাযের জন্য ওঠার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারেন এবং আপনার সকালটা চমৎকারভাবে শুরু করতে পারেন। যদি রাতে আপনি দেরিতে ঘুমাতে যান, তবে স্বাভাবিকভাবেই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হবে এবং আপনি সারাদিনই ক্লান্তি অনুভব করবেন।

ঘুমানোর আগে কখনোই একাধিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত করবেন না। এর ফলে আপনার রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে এবং অর্ধেক রাত বা রাতের কিছু অংশ আপনার নির্ঘুম কাটতে পারে। আপনার দিনের শেষে কাজগুলোকে কমিয়ে আনুন এবং দিনে দিনে আপনার অধিকাংশ কাজ শেষ করে নিন, যাতে করে রাতে ঘুমানোর সময় আপনি নিশ্চিন্তে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারেন।

৭. ফজর নামায কাযা হওয়াকে অন্য নামাযগুলো কাযা করার অজুহাত না বানানো 

ফজর নামায কাযা হওয়াকে অন্য নামাযগুলো কাযা করার অজুহাত বানাবেন না। যেমন- ‘আজ যেহেতু ফজর কাযা হয়ে গেছে, থাক, তাহলে আগামীকাল থেকেই আবার সব নামায পড়া শুরু করবো!’। সাবধান! এটা হবে শয়তানের অনেক বড় ফাঁদে পা দেয়া।

প্রতি ওয়াক্ত নামায স্বতন্ত্র একেকটি ফরয। প্রত্যেক নামাযের হিসাবও স্বতন্ত্র। আদায় করলে মহা প্রতিদান, অনাদায়ে মহা শাস্তি। তাই ফজর কাযা হয়ে গেলেও অন্য সকল ওয়াক্তের নামাযগুলো সঠিক সময়ে আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন যাতে সেগুলো কখনোই আপনার দ্বারা কাযা না হয়ে যায়। তাহলে নামাযগুলো যথা সময়ে আদায়ের ধারাবাহিকতায় পরদিন ফজরে ওঠাও আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। মনে রাখবেন, যথা সময়ে এশার নামায আদায় আপনার ফজর নামায আদায়ের জন্য হৃদয়কে উদগ্রীব ও প্রস্তুত করে তোলে।

উপসংহার

ধরা যাক, সকালে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার জন্য কোন ট্রেন বা বিমানের ফ্লাইট আমাদের ধরতে হবে অথবা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত কোন চাকরির ইন্টারভিউ রয়েছে। তখন আমরা নিজেরাই সকালে সময়মত ঘুম থেকে উঠে আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারি। ফজরকে যদি আমরা একইরূপ গুরুত্বের সাথে চিন্তা করতে পারি, ফজরের জন্য ঘুম থেকে উঠা আমাদের জন্য একইরূপ সহজ হবে।

হয়তো আমরা আমাদের অস্থায়ী দুনিয়াবী জটিলতায় অধিক জড়িত এবং আমাদের চূড়ান্ত পরকালীন লক্ষ্য সম্পর্কে অসচেতন।

আমাদের নিজেদের সবসময় চিন্তা করা উচিত, আমাদের দুনিয়াবী ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে কি আমরা আমাদের পরকালীন লক্ষ্য ও দায়িত্বের তুলনায় অধিক গুরুত্ব প্রদান করছি কিনা? এই চিন্তার মাধ্যমে হয়তো আমরা আমাদের আখেরাতের লক্ষ্যকে অন্যসকল কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গে সচেতন হতে পারি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর