কথা ও কাজে সত্যবাদিতা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সত্যবাদিতার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা হিসেবে এটাই যথেষ্ট যে, নবীদের স্তরের পরই সত্যবাদীদের স্তর। সত্যবাদী সম্পর্কে ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘সত্যবাদী হলেন সততা ও সত্যায়নে অতি সচেষ্ট। যে কিনা মুখে যা বলে কর্মে তা অনূদিত করে।’ ইসলামের মহান চরিত্রের অন্যতম গুণ সত্যবাদিতা। ইসলাম সত্যবাদিতার আদেশ দেয়। উদ্বুদ্ধ করে সত্যবাদিতায়। এটি নবী-রাসুল ও আল্লাহর নেক বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। এ গুণেই আল্লাহ বিশেষিত করেছেন তাঁর বন্ধুকে। তিনি এরশাদ করেন, ‘আপনি এই কিতাবে ইবরাহিমের কথা বর্ণনা করুন। নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী।’ (সূরা মরিয়ম : ৪১)। তিনি এ গুণেরই প্রশংসা করেছেন ইসমাইল (আ.) এর : ‘এই কিতাবে ইসমাইলের কথা বর্ণনা করুন, তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসুল, নবী।’ (সূরা মরিয়ম : ৫৪)।

আর আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি ও সবশেষ নবীর উপাধিই ছিল মহাসত্যবাদী, মহাসত্যায়িত, মহাবিশ্বস্ত ও সত্যবাদী। তাঁর ঘোর শত্রুরাও দিয়েছে এর সাক্ষ্য। বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে : যখন নাজিল হয় ‘আপনি নিকটতম আত্মীয়দের সতর্ক করে দিন।’ (সূরা শুআরা : ২১৪)। প্রিয়নবী (সা.) তখন সাফা পর্বতে আরোহণ করেন। তিনি ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, ‘হে ফিহর গোত্র! হে আদি গোত্র! এভাবে কোরাইশদের বিভিন্ন গোত্রকে ডাকতে থাকেন। অবশেষে তারা একত্রিত হলো। যে নিজে আসতে পারল না, সে তার প্রতিনিধি পাঠাল। যাতে দেখতে পায় ব্যাপার কী? সেখানে আবু লাহাব ও কোরাইশরাও এলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘বল তো, আমি যদি তোমাদের বলি যে, শত্রুসৈন্য উপত্যকায় এসে পড়েছে, তারা তোমাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করতে উদ্যত, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’ তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা আপনাকে সর্বদা সত্য পেয়েছি। তখন তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের সম্মুখে কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করছি।’

এ ব্যাপারে মোমিন জননী খাদিজা (রা.) তাঁকে যে গুণে বিশেষিত করেছেন তা কতই না সুন্দর! সর্বপ্রথম ওহির সাক্ষাতের পর নবীজির মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল তা ব্যক্ত করে খাদিজা (রা.) কে যখন বললেন, ‘আমি ভয় পেয়েছি যে আমার জীবন চলে যাবে।’ তখন খাদিজা (রা.) বললেন, ‘কখনও না, আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনও লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তা-বন্ধন রক্ষা করে চলুন এবং সদা সত্য বলুন।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

সত্যবাদিতার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা হিসেবে এটাই যথেষ্ট যে, নবীদের স্তরের পরই সত্যবাদীদের স্তর। সত্যবাদী সম্পর্কে ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘সত্যবাদী হলেন সততা ও সত্যায়নে অতি সচেষ্ট। যে কিনা মুখে যা বলে কর্মে তা অনূদিত করে।’ কোরআনুল কারিমে আল্লাহর নেয়ামতধন্যদের প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে ‘আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসুলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দিক (সত্যবাদী), শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা। আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম।’ (সূরা নিসা : ৬৯)। অতএব, যারাই নিজ অবস্থা ও নিজ দায়িত্ব অনুপাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর আনুগত্য করে, তারাই সে লোক যাদের ওপর আল্লাহ পূর্ণতা ও শুদ্ধতা এবং সৌভাগ্য ও সাফল্যের নেয়ামতে ভূষিত করেছেন। আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের শামিল করুন তাদের মধ্যে।

দেখুন সত্যের ঝান্ডা বহনকারী, নবী-রাসুলদের পর সর্বোত্তম মানব এবং এ উম্মাহর মধ্যে সেরা সিদ্দিক বা সত্যবাদী হলেন আবু বকর (রা.)। যিনি নবীজির ওপর সর্বপ্রথম (পুরুষদের মধ্যে) ঈমান এনেছেন এবং তাঁকে সত্যায়ন করেছেন। বোখারিতে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.) এর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দেবে?’ আমি বলেছিলাম, ‘হে লোকেরা, আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। তখন তোমরা সবাই বলেছ, আপনি মিথ্যা বলছেন আর আবু বকর বলেছে, আপনি সত্য বলেছেন।’ (আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করে দিন)।

সত্য যখন হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে যায়, সত্যবাদীর আকিদা, ইবাদত ও আখলাকে তার নিদর্শন দীপ্ত হয়ে ওঠে। তাই তো একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে রোজা রেখেছে?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি রেখেছি।’ অতঃপর রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো জানাজায় অংশগ্রহণ করেছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি।’ রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো মিসকিনকে খাবার খাইয়েছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি।’ রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ নিয়েছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তির মধ্যে একই দিনে এসব অভ্যাস পাওয়া যাবে, সে জান্নাতে যাবে।’ (মুসলিম)।

ঈমানদার ভাইয়েরা! জেনে রাখুন, সত্যবাদিতার সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্তর হলো আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সততা। আর তা এভাবে নিজে রবের তাওহিদে বান্দার বিশ্বাস স্থাপন, তাঁর ইবাদতে নিষ্ঠাবান হওয়া, তাঁর নিদর্শনাবলি ও তিনি নিজের নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে যা বলেছেন তা সত্যায়ন করা, তাঁরই ওপর নিখাদ আস্থা ও ভরসা রাখা, তাঁর কাছে যা আছে তাতে আস্থাশীল হওয়া এবং তাঁর নবীর অনুসরণ করা। কেননা, সত্যবাদিতা ও ইখলাস একে অপরের পরিপূরক। এ দুটি তাওহিদের কালেমা গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অঙ্গ ও মৌলিক শর্ত। যেমন বোখারিতে বর্ণিত হয়েছে, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো কেয়ামত দিবসে তাঁর শাফাআত লাভে সর্বাধিক সৌভাগ্যবান মানুষ কে হবে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ অন্তরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে।’ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে কেউ খাঁটি অন্তরে এ কথার সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।’

ইখলাস হলো উদ্দিষ্টকে একক বানানো আর সত্যবাদিতা হলো উদ্দেশ্যকে একক বানানো। বলাবাহুল্য, কোনো বান্দা সত্যবাদী হতে পারবে না সাধনা ও সহিষ্ণুতা ছাড়া। বান্দা সত্য বলতে বলতে এবং সত্য সন্ধান করতে করতেই এ উঁচু স্তর ও সমুচ্চ মর্যাদায় উপনীত হয়। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় সত্য পুণ্য বা ভালো কাজের পথ দেখায় আর ভালো কাজ বা পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। (এভাবে) একজন ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে (আল্লাহ ও মানুষের কাছে) সত্যবাদী হিসেবে গণ্য হয়। (পক্ষান্তরে) মিথ্যা অপরাধের পথ দেখায় আর অপরাধ জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। (এভাবে) একজন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে বলতে (আল্লাহ ও মানুষের কাছে) মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।’

সত্যবাদিতা বান্দাকে যেমন দুনিয়ার বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে, তেমনি তা মুক্তি দেবে আখেরাতের বিপদ ও সংকট থেকে। নিশ্চিত করবে দয়াময়ের সন্তুষ্টি লাভ জান্নাতে অনন্ত অবস্থান। দয়াময় সম্মানিত প্রভু বলেন, ‘আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে। তাদের জন্য উদ্যান রয়েছে, যার তলদেশে নির্ঝরিণী প্রবাহিত হবে; তারা তাতেই চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। এটিই মহান সফলতা।’ (সূরা মায়িদা : ১১৯)।

২১ রবিউস সানি ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর