বিশ্বাস ও কর্মে কোরআনের মহিমা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির পথ রচনা করতে কোরআনে হাফেজ বা বড় মাওলানা হওয়া জরুরি নয়। তবে কোরআন জানা ও মানা এবং কোরআন সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান থাকা জরুরি। তাওহিদ, রিসালাত, তকদির, আখেরাত, হক-বাতিল, সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে, সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলতে কোরআনি জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক

মোশারফ হোসেন পাটওয়ারী

মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী আল কোরআন। আল কোরআন রাসুল (সা.) এর সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা, নিখুঁত, নির্ভুল ও বিশুদ্ধ জ্ঞানভার। সর্বশ্রেষ্ঠ এ ধর্মগ্রন্থ মানবজাতিকে মুক্তির পথ দেখায়। তবে এর দ্বারা লাভবান হতে হলে কয়েকটি বিষয় গভীরভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশ্বাস ও আমলে প্রেমিক হতে হবে কোরআনের।

কোরআন জীবনসঙ্গী ও বন্ধু

ইসলাম মানে কোরআন, কোরআন মানে ইসলাম। দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির পথ রচনা করতে কোরআনে হাফেজ বা বড় মাওলানা হওয়া জরুরি নয়। তবে কোরআন জানা ও মানা এবং কোরআন সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান থাকা জরুরি। তাওহিদ, রিসালাত, তকদির, আখেরাত, হক-বাতিল, সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে, সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলতে কোরআনি জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। এতে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও আনুগত্য গভীর হবে, আমলে দরদ আসবে ও তাকওয়া অর্জিত হবে। এজন্য কোরআনকেই জীবনসঙ্গী ও বন্ধু বানাতে হবে, ইবলিশ শয়তান কিংবা বিধর্মীদের নয়। যে ব্যক্তি কোরআনুল কারিমকে বিশ্বাস ও আমলে বরণ করে নেয়, আল্লাহপাক তার বন্ধু হয়ে যান।

আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা

পবিত্র কোরআনের শব্দে শব্দে, আয়াতে আয়াতে আল্লাহপাক কথা বলেন। শুধু কোরআন খতম নয়, এর অর্থ মর্মে মর্মে গভীরভাবে চিন্তা ও গবেষণা করে নেক আমল করতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টার জীবন-জিন্দেগিকে কোরআনি জীবন-জিন্দেগিতে রূপ দিতে হবে। তবেই কোরআন তেলাওয়াতে অন্তরে আছর হবে, প্রতি শব্দে শব্দে আয়াতে আয়াতে আল্লাহর সঙ্গে কথা হবে, আল্লাহকে অতি কাছে পাওয়া যাবে। নচেৎ জীবনভর খুঁজেও তার দেখা মিলবে না। পবিত্র কোরআনের আলোয় যারা আলোকিত হতে পারবে, পৃথিবীর কোনো অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে পারবে না। কারণ একসময় পৃথিবীর সব আলো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে; কিন্তু পবিত্র কোরআনুল কারিমের আলো চির অমান। আর কোরআন মজিদ তেলাওয়াতই হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বোত্তম জিকির। কোরআনুল কারিম থেকে যে যত দূরে সে তত ধ্বংসের কাছাকাছি।

উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?

কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তাহলে কি তারা কোরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলো তালাবদ্ধ হয়ে আছে?’ (সূরা মুহাম্মদ : ২৪)। ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষ যাদের অন্তর আছে বটে; কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝে না, তাদের চোখ আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল-উদাসীন।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯)। ‘আমি কোরআন সহজ করে দিয়েছি, উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ (সূরা কামার : ১৭)। ‘নিশ্চয়ই এ এক উপদেশ, অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে পথ অবলম্বন করুক।’ (সূরা দাহর : ২৯)। ‘কোনো মিথ্যা এতে প্রবেশ করবে না, সম্মুখ থেকে কিংবা পশ্চাৎ থেকে, তা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ।’ (সূরা হা-মিম-আস-সাজদা : ৪২)। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোরআন সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই বেশিরভাগ জ্ঞানী-গুণী কোরআনের প্রকৃত জ্ঞান থেকে দূরে সরে রয়েছে।

আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উছিলা

কোরআন তেলাওয়াত সব ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর এ তেলাওয়াত যদি হয় নামাজে, তবে তা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। নামাজে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দা যখন আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদায় পড়ে কাঁদতে থাকে, তখন সে প্রিয় বান্দাকে আল্লাহ নিজে রহমতের চাদরে ঢেকে নেন। স্বীয় রহমতের হাত বান্দার মাথা ও পিঠের ওপর বুলাতে থাকেন। ওই বান্দার প্রতি আল্লাহর মহব্বতের সব দরজা খুলে দেন। এমন প্রিয় বান্দা আল্লাহ্র কত নিকটে চলে যায়, জগতের কেউ তা টের পায় না। হজরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেছেন, ‘আমি আল্লাহকে স্বপ্নযোগে দর্শন করে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া আল্লাহ! কোন বস্তুর উছিলায় আপনার সান্নিধ্য লাভ করা যায়? আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার বাণী কোরআন শরিফের উছিলায়।’ (ইমাম গাজ্জালি-কিমিজায়ে সাআদাত : ১ম খ-, ৮ম পরিচ্ছেদ)।

দুনিয়ার সামনে কোরআনের চ্যালেঞ্জ

পবিত্র কোরআন না বোঝার বা না জানার কারণেই কোরআনের বিরুদ্ধে, রাসুল (সা.) এর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হয়। মূলত কোরআনের প্রতিটি আয়াতই এর সত্যতার দলিল। দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াব হওয়ার একমাত্র বিধান। এমন উচ্চাঙ্গের বিশুদ্ধ ভাষা, ছন্দ, অলংকার, উপমা, শব্দচয়ন, সাহিত্যমান, বর্ণনাভঙ্গি, উপস্থাপনা, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলির বিবরণ, বহুবিদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমাহার, বৈজ্ঞানিক সঠিক তথ্যাবলি, ১৯ সংখ্যাটির মাধ্যমে নিপুণ গাণিতিক ফর্মুলা, যুগোপযোগী বিষয়ের নিখুঁত গাঁথুনি ও বর্ণনা, হৃদয়ে গভীর প্রভাব সৃষ্টিতে অপূর্ব রহস্যময়তা এবং এমন পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান রচনা করা মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারও দ্বারাই সম্ভব নয়।

সে যুগের নামকরা পতিরা যখন কোরআনের আয়াতগুলোকে রাসুল (সা.) এর রচিত বলে প্রচার ও প্রপাগান্ডা শুরু করে, তখন আল্লাহ পাক স্বয়ং আল কোরআনের চ্যালেঞ্জ দিয়ে এরশাদ করেন ‘নিশ্চয়ই আল কোরআন জগৎগুলোর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। জিবরাইল এটি নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন।’ (সূরা শুআরা : ১৯২-১৯৩)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, ‘সে (মোহাম্মদ সা.) যদি আমার নামে কোনো কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করত, আমি অবশ্যই তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম এবং কেটে দিতাম তাঁর জীবন ধমনি। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউই নেই যে, তাঁকে রক্ষা করতে পারে।’ (সূরা হাককাহ : ৪৪-৪৭)। তাই তো আল্লাহপাক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন ‘তারা কি বলে, সে (মুহাম্মদ সা.) কোরআন নিজে রচনা করেছে? বলো, তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে তোমরা এর অনুরূপ ১০টি স্বরচিত সূরা আনয়ন করো এবং আল্লাহ ব্যতীত অপর যাকে পার ডেকে লও।’ (সূরা হুদ : ১৩)।

কিন্তু পতিরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলো। ১০টি সূরা দূরে থাকুক, একটি ছোট সূরাও তারা রচনা করতে পারল না। আল্লাহ তায়ালা আবারও চ্যালেঞ্জ করে বললেন, ‘আমার বান্দার প্রতি যা (আল কোরআন) নাজিল করেছি, তাতে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ হয়, তবে তেমন একটি সূরা নিয়ে এসো এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সব সাহায্যকারীদের আহ্বান করো।’ (সূরা বাকারা : ২৩)। আল কোরআনের শত্রুরা একটি সূরা রচনা করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেও সমর্থ্য হলো না। বস্তুত আল্লাহর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো শক্তি কারও নেই।
আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘(হে নবী) তুমি বলো, যদি সব মানুষ ও জিন এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় যে, তারা এ কোরআনের অনুরূপ বানিয়ে আনবে, তাতেও তারা এর মতো কিছু আনতে পারবে না, যদিও এ ব্যাপারে তারা একে অপরকে সাহায্য করে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৮৮)। হে আল্লাহ! মুসলমানদের আত্মাকে কোরআনশূন্য নয়, কোরআনপূর্ণ করে দিন।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর