পতাকার ফেরিওয়ালা

রোজ লোকটিকে দেখে অনিন্দ্য। স্কুলের দিনে স্কুলের সামনে লোকটি খাবার বেচে। ফেরিওয়ালা। তবে সবসময় একই খাবার বেচে না। মুড়িওয়ালা মুড়ি মাখানো বিক্রি করে। ফুচকাওয়ালা ফুচকা। লোকটা একেক সিজনে একেক রকম জিনিস ফেরি করে। আমড়ার সিজনে আমড়া। কখনও শসা। কখনও বরই। কখনও বা আবার তেঁতুল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হয় মার্চ মাস এলে। লোকটা তখন স্কুলের সামনে বড় একটা বাশের সঙ্গে ছোট বড় হরেক রকম পতাকা নিয়ে আসে। জাতীয় পতাকা। স্কুলের সময়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়েই ফেরি করে। ছেলেমেয়েরা সাধারণত পাঁচ টাকা দশ টাকা দামের ছোট ছোট পতাকাই কেনে। স্কুল শেষ হলে লোকটা বেরিয়ে পড়ে। পথে পথে পতাকা ফেরি করে চলে।

অনিন্দ্যর স্কুলটা বেশ মজার। খুব একটা অভিজাতও নয়, আবার একেবারে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মতো নয়। এখানে বাংলাও আছে, আবার ইংরেজি ভার্সনও আছে। আমার বাবা আমাকে বাংলা ভার্সনে দিয়েছেন। বাবা পত্রিকায় চাকরি করেন, পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। বাংলা ভাষার ওপর বাবার অনেক টান। তাই তো অনিন্দ্যকেও বাংলা শেখার ওপর জোর দিয়েছেন।
ছাবি্বশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিনে স্কুলে স্বাধীনতার অনুষ্ঠান। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনিন্দ্য বেশ সকালেই একটা লাল সবুজ রঙা টি-শার্ট পরে বাবার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে স্কুলে এল। স্কুল কম্পাউন্ডে বেশ ভিড়। আজ স্কুলের গেট সবার জন্য উন্মুক্ত। ফেরিওয়ালাদের জন্যও। হরেক রকম ফেরিওয়ালাদের মধ্যে অনিন্দ্য সেই পতাকার ফেরিওয়ালাকেও দেখতে পেল। আজ তার পতাকার বিক্রিবাটা বেশ ভালো। বিশেষত ছোট ছোট পতাকা সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আছে বড় সাইজের পতাকা। অনিন্দ্যের একটা পতাকা কেনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অত বড় পতাকা কি বাবা কিনে দেবে?
অনিন্দ্য বাবাকে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা, দেখ, আমাদের পতাকাওয়ালা।’
বাবা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। ভাবলেন, ছেলে বোধ হয় পতাকা কিনতে চায়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পতাকা কিনবে?’
‘কিন্তু ওগুলো তো অনেক বড়!’
‘পতাকাওয়ালাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখি ওর ঝোলার মধ্যে ছোট পতাকা আছে কি-না!’
বাবা পতাকাওয়ালাকে ডাকলেন। পতাকাওয়ালা একগাল হেসে বলল, ‘না স্যার, ছোটগুলান সব বিক্রি হয়ে গেছে। সোনামণির জন্য একটা বড় পতাকা নেন স্যার, ছোটর দামেই দিয়ে দেব স্যার।’
বাবা একটা পতাকা কিনে দিলেন। অনিন্দ্য সেটা কাঠির মাথায় ঝুলিয়ে পতপত করে ওড়াতে লাগল।
অনুষ্ঠান শুরু হতেই সবাই অনুষ্ঠানের দিকে চলে এল। নানারকম অনুষ্ঠান, কুচকাওয়াজ, মুক্তিযুক্তের নাটক দেখতে দেখতে অনিন্দ্য আবিষ্কার করল ছোট ছোট অনেক পতাকা এখানে সেখানে ছড়ানো আছে। কাগজের পতাকাই শুধু নয়, ফেরিওয়ালার কাছ থেকে থেকে কাপড়ের পতাকাও আছে। পতাকার আকর্ষণ মিটে যাওয়ায় সবাই ঝামেলা মনে করে হাত থেকে ফেলে দিয়েছে।
অনিন্দ্য বাবাকে ডেকে দেখাল, ‘বাবা, বাবা, দেখ পতাকা।’
বাবা ভেবেছেন ছেলে বোধ হয় এই পতাকা কুড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ফেলে দেওয়া জিনিস নিতে নেই।’
তখন অনিন্দ্য বাবাকে দেখাল পতাকার ফেরিওয়ালা ফেলে দেওয়া পতাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে তার ঝোলায় ভরছে।
বাবার রাগ হলো। ব্যাটা ধান্দাবাজ, তাহলে এই কুড়িয়ে নেয়া পতাকাই আবার কোমলমতি শিশুদের কাছে বিক্রি করে!
বাবার সাংবাদিক সত্তা জেগে উঠল। এগিয়ে গিয়ে পতাকার ফেরিওয়ালাকে পাকড়াও করল। বয়স্ক ফেরিওয়ালা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘না স্যার, সোনামণিদের কাছে আমি এই পতাকা বেচিনে।’
‘তাহলে ওগুলো নিয়ে কি কর?’
‘তাকে তুলে গুছিয়ে রেখে দেই।’
‘কেন?’
‘মাটিতে পড়ে থেকে পতাকার অপমান হয়। পায়ের নিচে, জুতোর নিচে, নোংরা নালায় পড়ে পতাকার অপমান হয়। ও অপমান আমি সহ্য করতে পারিনে। দেখা চোখে যতগুলো পারি ততগুলো তুলে নেই।’
সাংবাদিক বাবা ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি তখনই পতাকাওয়ালার ইন্টারভিউ নিলেন। জানতে পারলেন, পতাকাওয়ালা একজন মুক্তিযোদ্ধা। অভাবের তাড়নায় ফেরি করে সংসার চালান। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো স্বীকৃতি পাননি। তাই বলে তার কোন আক্ষেপ নেই। শুধু এইভাবে পতাকার অপমান দেখলে কষ্ট পান। যে পতাকার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিলেন দরকার মিটে গেলে সেই পতাকা পড়ে থাকে রাস্তায়, পায়ের নিচে, নোংরায়, নালায়, নর্দমায়, ডাস্টবিনে। এটাই তিনি সহ্য করতে পারেন না।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর