অভিযানের লক্ষ্য নিয়ে ধোঁয়াশা

বাঙালী কন্ঠঃ দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজ গডফাদারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামার ঘোষণা দিয়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের তিন প্রভাবশালী নেতাকে গ্রেপ্তার করলেও এসব অপকর্মের গডফাদার হিসেবে অভিযুক্ত ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোলস্না মো. আবু কাওছারের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এমনকি ক্ষমতাধর এ যুবলীগ নেতা গত পাঁচ দিন ধরে দলেবলে সজ্জিত হয়ে কাকরাইলের নিজ আস্তানায় অবস্থান করলেও সশস্ত্রর্ যাব-পুলিশ সেখানে ঢু দিতেও সাহস পায়নি। আইন রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা জানান, উপরমহল থেকে গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়ায় তারা এখনো সম্রাটকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয়নি। তবে যে কোনো মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এত দিন সম্রাটের অফিসের চারপাশের্ যাব-পুলিশের সশস্ত্র টহল ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তীক্ষ্ন নজরদারি থাকলেও সোমবার ভোর থেকে তাদের আর সেখানে দেখা যায়নি।

এ অবস্থায় সরকারের এ শুদ্ধি অভিযানের লক্ষ্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। চলমান অভিযান দুর্নীতিবাজ কিংবা চাঁদাবাজ গডফাদারদের বিরুদ্ধে, নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ রয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তর্ যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর মাঠপর্যায়ের সদস্যরাও এ নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন।

অন্যদিকে রোববার ভর দুপুরে মতিঝিলের চারটি খ্যাতনামা ক্লাবে ফাঁকা অভিযান চালিয়ে জুয়ার বোর্ড, ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, মদ ও জুয়ার টাকা উদ্ধার এবং গুলশানের স্পা সেন্টার থেকে ১৬ নারীসহ ১৯ জনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সবকিছুতেই তালগোল পাকাতে শুরু করেছে। অভিযানে অংশ নেওয়া মাঠপর্যায়ের সদস্যদের ভাষ্য, যে কৌশলে এ অভিযান চলছে, তাতে চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও ওই জালে রাঘববোয়ালদের টেনে তোলা অসম্ভব। এ ধরনের অভিযানে আতঙ্ক সৃষ্টি হলেও এর ফলাফল শূন্য হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।

তাদের এ ধারণা যে একেবারে অমূলক নয়, তা গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, যে কোনো অভিযান সুনির্দিষ্ট ছকে হওয়া জরুরি। নানামুখী অভিযান একসঙ্গে শুরু করা হলে তাতে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। এতে অভিযানের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হওয়াটাই স্বাভাবিক। টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি-সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে

আকস্মিক বেশকিছু ‘ছুটকে’ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে- যা নিয়মিত অভিযানের অংশ হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তারা।

এদিকে অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের এডিসি পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, বাহ্যিক দৃষ্টিতে চলমান অভিযান কিছুটা এলোমেলো মনে হলেও এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত। নির্ধারিত ছকেই তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিযানে কিছু চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও মূল হোতারা কেউই পার পাবে না।

দায়িত্বশীল এ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত বুধবার রাতে (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকে যেসব নেতাকর্মী সম্রাটের অফিস দলবদ্ধ হয়ে পাহারা দিচ্ছেন, এদের একটি বড় অংশ মাদক ব্যবসায়ী। তারা অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় জুয়ার বোর্ডও পরিচালনা করেন। তারা মূলত তাদের নিজেদের অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার জন্যই সম্রাটের গ্রেপ্তারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চাইছেন। এদের মধ্যে ১২৮ জনের নাম ঠিকানা ও তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি পুলিশ জোগাড় করেছে। পৃথকভাবে এদের গ্রেপ্তারে শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে। এসব নেতাকর্মী যাতে সম্রাটের কার্যালয়ে দলবদ্ধভাবে অবস্থান না করে এজন্য সেখানকার টহল কার্যক্রম ও গোয়েন্দা নজরদারি কিছুটা ঢিলেঢালা করা হয়েছে। এ কৌশল নেওয়ার পর গত কয়েকর দিন ধরে সম্রাটের অফিসে অবস্থান নেওয়া বেশকিছু নেতাকর্মী সেখান থেকে সরে গেছেন। এতে তাদের ধরপাকড়ের পথ প্রশস্ত হয়েছে। পুলিশের ওই কর্মকর্তার দাবি, চলমান অভিযান নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকলে তা সহসাই দূর হবে। একই সঙ্গে এ অভিযানের বড় চমকও জনগণ দেখতে পাবে।

তবে অভিযান পরিচালনার ধরন এবং এর কৌশলগত নানা দুর্বল দিক পর্যালোচনা করে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের ধরতে যে শক্ত জাল দরকার, তা হয়তো সরকারের হাতে নেই। তাই ছেড়া জাল নিয়েই মাছ শিকারে নেমেছে।’ পুলিশের যেসব কর্মকর্তা এত দিন ক্লাবপাড়ায় ডজন ডজন ক্যাসিনো চালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন, তারাই এখন অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। আর তাই তারা ক্যাসিনো পরিচালনাকারী নেপালিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন অপরাধ পর্যবেক্ষকরা।

এদিকে যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রশাসনের যেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি গণপূর্তসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ না নেওয়ায় চলমান অভিযানের লক্ষ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

তাদের ভাষ্য, খোদ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনে দুর্নীতির বিশাল বিষবৃক্ষ গজিয়ে উঠেছে। তাই তা নিধন না করে রাজনীতিক কিংবা সাধারণ মানুষের দুর্নীতি দমন করা কঠিন হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো, মদ ও জুয়ার আখড়া গড়ে ওঠার পেছনে দুর্নীতির বিশাল ভূমিকা রয়েছে দাবি করে তারা বলেন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে যারা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, তারাই জুয়ার বোর্ডে লাখ লাখ টাকা বাজি ধরতে পারছেন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাড়া-মহলস্নার ক্লাবে এক-দেড় হাজার টাকার জুয়া খেলার প্রবণতা থাকলেও তাদের পক্ষে ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনোতে বড় বাজি ধরার সামর্থ্য নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা দফায় দফায় বলা হলেও তা বেশিদূর এগোতে পারেনি। এমনকি দল থেকে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের পাকাপোক্তভাবে সরানো যায়নি। গুটি কয়েক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ নেতাকে পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও সাংগঠনিক ক্ষমতার মূল বলয়েই থেকেছেন। ফলে শুদ্ধি অভিযানের সফলতা বরাবরই অধরা থেকেছে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, নেতাকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের ইমেজে চির ধরায় এবারের শুদ্ধি অভিযানের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। অথচ তা মাদক নির্মূল অভিযানের মতোই দুর্বল ছকে পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযানের শুরুতে বিপুলসংখ্যক ইয়াবার গডফাদার কৌশলে পাতানো আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যেভাবে জেলে বসে নিরাপদে তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, এবারের শুদ্ধি অভিযানেও একই ধরনের ফল মিলবে বলে মনে করেন তারা।

সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের কাকরাইলের অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের মূল গেটের কলাপসিবল গেট লাগানো রয়েছে। ভেতরে পস্নাস্টিকের চেয়ারে নিয়ে দুজন সিকিউরিটি গার্ড বসে রয়েছেন। ভবনের আশপাশে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলেও তারা যুবলীগের কোনো কর্মী নন বলে দাবি করেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ নামের একজন তরুণ জানান, তার বড় ভাই শাহজাহানপুর এলাকার পদধারী যুবলীগ নেতা। গত চার দিন ধরে তিনি বাড়িতে যাচ্ছেন না, তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। তার সহযোগীরা জানিয়েছে, তিনি সম্রাটের অফিসে আছেন। তাই তাকে খুঁজতে এসেছেন।

আসিফ জানান, সিকিউরিটি গার্ডদের তিনি তার ভাইয়ের নাম বলার পরও তারা তাকে চিনতে পারেননি। অফিসের ভেতরে কোনো নেতাকর্মী নেই বলেও সাফ জানিয়ে দেন তারা। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি অফিসের সামনে রাস্তায় অপেক্ষা করছেন। ভেতর থেকে কেউ বের হলে ভাইয়ের খবর পাওয়া যাবে এমন আশায় ছিলেন। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি তার ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে বাসায় ফিরে যান।

এদিকে বুধবার রাত থেকে সম্রাট তার অফিসে আছেন, চারদিকে এমন প্রচারণা থাকলেও বিষয়টি কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। তার দলীয় কর্মীদের কারও কারও দাবি, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর কোনো একসময় সম্রাট তার অফিস ছেড়ে চলে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তাকে গোপন এ সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে তিনি এখনো দেশ ছাড়েননি।

যদিও সম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই এ তথ্য ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, প্রয়োজনে গ্রেপ্তার হলেও ভীরু-কাপুরুষের মতো অফিস থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো নেতা নন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর