আমার বউ কয়েকদিন আগেও ছেলে ছিল

পুরুষ থেকে নারী হয়ে এখন দিব্যি সংসার করছেন আজকের শ্রী আর এক সময়ের ঘটক মুহুরি। তাকে খুশি মনে মেনে নিয়েছেন বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির লোকজন। আর এই পরিবর্তনে তার নিজের লড়াইয়ের থেকে তার পরিবারের যুদ্ধ কিছু কম কঠিন ছিল না। সেই লড়াই লড়েও চোখে কী অসম্ভব ভালবাসা আর গলায় দুরন্ত দৃঢ়তা নিয়ে শ্রীর স্বামী সঞ্জয় মুহুরি বলছিলেন, ‘বিষয়টা সবার পক্ষে হজম করা কঠিন। আমার বউ কয়েকদিন আগেও শরীরে ছেলে ছিল, এটা খবরের কাগজে বেরোলে কী পরিমাণ চর্চা হবে সেটা আমি জানি। সর্বত্র আরও নানারকম রসালো আলোচনা চলবে। আমাকে দেখলে অনেকের গুজগুজ ফুসফুস আর কৌতূহল আরও বাড়বে। তবু আমি চাইতাম, শ্রীর জীবন ওর মতো আরও অনেকে জানুক। তারাও নিজের শর্তে বেঁচে থাকার সাহস পাক।’

 

তুমুল আত্মবিশ্বাস আর নিয়ন্ত্রিত আবেগে শ্রীর মা পূর্ণিমা ঘটক বলছিলেন, ‘শ্রী-এর বিয়েতে আমি কোনও স্ত্রী-আচার, কোনও নিয়ম, অনুষ্ঠান বাকি রাখিনি। ছেলে হয়ে জন্মেছিল বটে কিন্তু এখন তো ও আমার বড় মেয়ে। কেনাকাটা, গয়না গড়ানো, জল সইতে যাওয়া, সারারাত মেহেন্দি পরা, নাচ, আইবুড়ো ভাত সব হয়েছে বিয়েতে। সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। সবাই এসেও ছিলেন।’

 

বলছিলেন, ‘এ তো ঘরে লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। শ্রী তো আকাশ থেকে পড়েনি বা মাটি ফুঁড়ে বেরোয়নি। ওর মতো আরও যারা আছে তারাও কারও না কারও সন্তান। এই পৃথিবীতে, এই সমাজে যুগ-যুগ ধরে ওরা আছে। তা হলে মানতে না-চাওয়া কেন?’

 

কলকাতার সল্টলেট বৈশাখীর সরকারি আবাসনে বড় হয়েছেন শ্রী। বাড়ির বড় ছেলে। তখন নাম অন্য ছিল। বাবা সরকারি চাকুরে। বাড়িতে বাবা-মা-ছোট বোন আর প্রায় সমবয়সী ছোট কাকা। সে সময়ে মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। ছিল না কেবল চ্যানেল। মানুষের ‘জানা’-র জগৎটা অনেক ছোট ছিল। রূপান্তরকামীদের অস্তিত্ব, আন্দোলন, জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন শ্রী নিজে এবং তার আশপাশের মানুষেরা। কিন্তু শরীরটা ছেলের হলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকে শ্রী আপনা থেকেই নিজেকে মেয়ে বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। আবাসনে মেয়েরাই ছিল তার বন্ধু। নিজেকে অস্বাভাবিক না-ঠেকলেও চারপাশের মানুষের চোখে সেটা ধরা পড়েছিল।

 

পূর্ণিমাদেবী বলছিলেন, ‘ও যখন ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ে, ও যে অন্যরকম সেটা বুঝতে শুরু করলাম। আমাকে প্রথম সরাসরি বলেছিল আমার ছোট দেবর। ও আমার কাছেই মানুষ। এক দিন আমায় বলল, ‘বৌদি, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে তো এইরকম মানুষ ছিল। ও সে রকম। তোমরা কেন বুঝছ না? ওকে ওর মতো থাকতে দাও। যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেবে, ওর পাশে থাকবে, তত ভাল।’

 

‘আমার স্বামীও সব বুঝতেন। চুপ করে থাকতেন। আত্মীয়দের নিয়ে সমস্যা হত। একটা সময় পর সমস্ত পারিবারিক উৎসব, অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। তবে শ্রীর বিয়েতে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। বেশিরভাগই এসেছেন এবং কোনও সমস্যা তৈরি করেননি।’

 

শ্রীর কথায়, তার মা এবং সঞ্জয়- এই দু’জন না থাকলে কবে, কোথায় ভেসে যেতেন। ক্লাস এইটে নানা ঝামেলায় বিডি স্কুল ছেড়ে কেষ্টপুরের অনামী স্কুলে ভর্তি হতে হল। তখন বয়ঃসন্ধি শুরু। শারীরিক-মানসিক-পারিপার্শ্বিক টানাপড়েনে তিনি দিশেহারা, একা। নতুন স্কুলে এসে ভাগ্যক্রমে সহানুভূতিশীল কিছু স্যর পেলেন, পেলেন দুই বন্ধুকে। তাদের এক জন ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর অন্য জন এই সঞ্জয়। ভালবাসা হাতড়ে বেড়ানো শ্রী বন্ধুত্ব আর ভালবাসা-র মধ্যে গুলিয়ে ফেলে মনে-মনে ফার্স্ট বয়টির প্রেমে পড়লেন এবং একটা সময়ে ধাক্কা খেলেন। সেই সময় হাতটা শক্ত করে ধরলেন সঞ্জয়। তখন কোনও প্রেমটেম ছিল না। ক্রমশ অনেকগুলো বছর পাশাপাশি অনেক চড়াই-উতরাই কাটিয়ে কখন যেন বন্ধুত্ব, মায়া-মমতা-সহানুভূতি-প্রেম সব একাকার হয়ে গেল। দু’জনে দু’জনকে পড়তে পারলেন স্পষ্টভাবে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। কঠিন সিদ্ধান্ত।

 

এরপর শারীরিক ভাবে মেয়েতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন শ্রী। পুরো খরচটাই দিলেন সঞ্জয়।

 

শ্রী বলছিলেন, ‘অসম্ভব কঠিন একটা প্রক্রিয়া। যেমন শরীরে যন্ত্রণা হয় তেমনই মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন হতে হয়। বাড়ির সাপোর্টটা এইসময় ভীষণ-ভীষণ দরকার। আমাকে ক্রমাগত মা আর সঞ্জয় সামলে গিয়েছে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় একটা সময় থেকে মেয়েদের পোশাকে বাইরে বেরোনো শুরু করতে হয়। তখন মারাত্মক টিটকিরির মুখে পড়তাম। বেরোতে চাইতাম না। মা তখন আমাকে সাহস দিয়ে বলতেন, খুব সমস্যা হলে আমি যেন মা-কে ফোন করি। মা গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে আনবে।’

 

কলকাতার এক প্রান্তে আপাত সাধারণ দুই পরিবারের গতভাঙা-বলিষ্ঠ পদক্ষেপে শ্রীময় হয়ে উঠছে একজোড়া জীবন। -আনন্দবাজার পত্রিকা
Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর