ল্যাপটপ ক্রয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের টেন্ডারে ডক্যুমেন্টে অযৌক্তিক শর্ত

বাঙ্গালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বিশেষ সিন্ডিকেটকে’ কার্যাদেশ দিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২৬ হাজার ইউনিট ল্যাপটপ, স্পিকার ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টের টেন্ডার ডক্যুমেন্টে বিশেষ শর্ত জুড়ে দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর।

এক্ষেত্রে আইটি খাতের স্থানীয় শিল্পোদ্যাক্তাদের ধারণা, বিশেষ কোনো মহলকে কাজ পাইয়ে দিতে আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের টেন্ডার শিডিউল প্রণয়ন করা হয়েছে। যা কিনা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাজধানীর মিরপুর-২ এ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মাল্টিপারপাজ হল রুমে অনুষ্ঠিত ‘পরি-টেন্ডার মিটিং’ এ এসব কথা জানান স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তারা।

এ সময় ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস), ডাটা সফট ও ওয়ালটনের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নেন।

অন্যদিকে বিদেশি পণ্য আমদানিকারক এজেন্টদের মধ্যে ফ্লোরা টেলিকম, ফ্লোরা লিমিটেড, গ্লোবাল বাংলাদেশ, স্মার্ট টেকনোলজিস, থাকরালের প্রতিনিধিসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

সভায় টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হায়দার চৌধূরী জানান, টেন্ডারে প্রতিটি লটে পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ হিসেবে যে বিশাল পরিমাণ টাকার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা পূরণ করার সামর্থ্য নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি ছাড়া অন্য কারো নেই। এর ফলে স্থানীয় আইটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য টেন্ডার অংশগ্রহণে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের কিছু সাহসী উদ্যোক্তা আইটি শিল্প খাতে বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসায় এ খাতের বিকাশ শুরু হয়েছে। তাই দেশীয় ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এতো বিশাল অঙ্কের পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ দেয়া অসম্ভব। এরই প্রেক্ষিতে, বিদ্যমান টাকার অঙ্ক কমিয়ে যৌক্তিক পরিমাণ অর্থ নির্ধারণের অনুরোধ জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেশীয় শিল্প বিকাশের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। সেজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন। অথচ সরকারি ক্রয় নীতিতে সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। বরং বিশেষ ধরণের শর্ত জুড়ে দিয়ে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ফলে সম্ভাবনাময় এ খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি উৎসাহিত হচ্ছে। জানা গেছে, ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৪’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ল্যাপটপ, স্পিকার ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কিনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর গত ৮ নভেম্বর তিনটি পৃথক দরপত্র আহ্বান করেছে। প্রতিটি টেন্ডারেই ৫টি লটে ২৬ হাজার ইউনিট করে পণ্য কেনা হবে।

উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ওই সব টেন্ডারের কারিগরি বিনির্দেশে প্রত্যেক লটে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য বিগত ৫ বছরে সর্বোচ্চ ২টি চুক্তির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের (প্রায় ৩০ কোটি টাকা) পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ থাকার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোম্পানি সব লটে অংশগ্রহণ করতে চাইলে ল্যাপটপের জন্য প্রায় ১৫০ কোটি, স্পিকারের জন্য প্রায় ১৮ কোটি এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টের জন্য প্রায় ১৩৪ কোটি টাকার পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ থাকতে হবে।

এছাড়াও টেন্ডার ডক্যুমেন্টে অরিজিনাল উইন্ডোজের সঙ্গে এন্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার, বাংলা ফন্ট হিসেবে বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের পরিবর্তে অভ্র দেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে।

প্রি-টেন্ডার সভায় বিদ্যমান শর্তকে অবাস্তব, অযৌক্তিক ও দেশীয় শিল্প বিকাশের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র মতে, টেন্ডার ডকুমেন্টের বিদ্যমান শর্ত বাস্তবতার নিরিখে সংশোধনের জন্য সভায় তারা বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। সে সময় তাদের উত্থাপিত যৌক্তিক দাবি বা প্রস্তাবনার বিপক্ষে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। এ অবস্থায় অসাধু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজটি বিদেশি পণ্য আমদানিকারক এজেন্টরা বাগিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় উৎপাদকরা।

তাদের মতে, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান না থাকার সুযোগে আমদানিকৃত আইটি পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রকল্পের বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাবে।

অন্যদিকে এ খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিশাল বিনিয়োগই শুধু ঝুঁকির মুখে পড়বে না; হাই-টেক পার্কে বিদেশি বিনিয়োগও নিরুৎসাহিত হবে।

এরইমধ্যে কারিগরি বিনির্দেশে (টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন) প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার জন্য ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৪’ এর প্রকল্প পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে টেশিস। ওই চিঠিতে, কারিগরি বিনির্দেশে পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ হিসেবে যে বিশাল পরিমাণ টাকার শর্ত দেয়া হয়েছে, তা কমিয়ে বাস্তব ও যৌক্তিক পরিমাণ অর্থ নির্ধারণের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি, অরিজিনাল উইন্ডোজ নিজেই এন্টি ভাইরাস হিসেবে কাজ করে বিধায় টেন্ডার ডক্যুমেন্টে বিদ্যমান শর্ত সংশোধন করে শুধুমাত্র অরিজিনাল উইন্ডোজ এবং বাংলা ফন্ট হিসেবে বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের কথা উল্লেখ করার অনুরোধ করেছে টেশিস।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্মার্ট ফোনে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিতে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো হয়েছে। নানাভাবে দেশীয় নির্মাতাদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। সেখানে এ ধরনের শর্তারোপ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অফিসিয়াল প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ ধরনের শর্ত পরিবর্তন না হলে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের প্রকিউরমেন্ট পরিচালক ও ‘প্রাইমারি এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-৪’ এর প্রকল্প পরিচালক মো. হাসান সরওয়ার জানান, টেন্ডার ডকুমেন্টের বিদ্যমান শর্ত সংশোধনের এখতিয়ার তাদের নেই। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে একমাত্র টেকনিক্যাল কমিটিই শর্ত সংশোধন বা শিথিল করতে পারবে। প্রি-টেন্ডার মিটিং এ দেশীয় শিল্পোদ্যাক্তাদের পক্ষ থেকে শর্ত সংশোধনের যেসব দাবি ও প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, তা টেকনিক্যাল কমিটিতে পাঠাবো। আশা করি- দেশীয় শিল্প সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর