সিটিং বাস বন্ধ নিয়ে নয়া অরাজকতা: জিম্মি যাত্রীরা

রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ নিয়ে গণপরিবহনের অব্যাহত নৈরাজ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে কর্মজীবী নারী এবং শিক্ষার্থীসহ লাখো যাত্রী। বিভিন্ন সময়ে নৈরাজ্য বন্ধে আলোচনা-সমালোচনা হলেও দিন শেষে মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। এক্ষেত্রে বিআরটিএর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর সঙ্কটকালে বিআরটিসির বাসও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সকালের খবরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তার মূলে রয়েছে বিআরটিএ। তারা গণপরিবহন সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। গণপরিবহন সম্পর্কিত কোনো পেশাদার লোক এখানে নেই। ফলে টেকসই সমাধান হচ্ছে না। তারা সমস্যা সমাধান না করে আরও জটিল করছে। বাসচালক শাস্তি পাওয়ার প্রতিবাদে কিছু দিন আগেও সারাদেশ একপ্রকার অচল করে রেখেছিল পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রকরা। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় বসে ওই ধর্মঘটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পরিবহন খাতের এমন নৈরাজ্যের নজির রয়েছে অনেক। সর্বশেষ রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার কারণে যাত্রীদের শায়েস্তা করতে কৃত্রিম পরিবহন সঙ্কট সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। নানা অজুহাতে পরিবহন মালিকদের অনেকেই গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন না। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বাস চলছে, সে সবেও ইচ্ছে মতো ভাড়া আদায় করার পাশাপাশি যাত্রীদের নানারকম হয়রানি করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, যেসব মালিক তাদের গাড়ি রাস্তায় বের করবেন না তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। কিন্তু এই রুট পারমিট বাতিল কি এতই সহজ? জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার সকালের খবরকে বলেন, যেসব মালিক রাস্তায় গাড়ি বের না করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে যাত্রী ভোগান্তি বাড়াচ্ছে তারা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। শিগগির তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইচ্ছে করে গাড়ি না চালালে তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে। রুট পারমিট নেওয়ার শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট রুটে পরিবহন চালানো, যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়া নেওয়া, ভাড়ার তালিকা গাড়ির ভেতর টানিয়ে রাখাসহ বেশকিছু নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। তবে আইনে গাড়ি চালানোর বাধ্যবাধকতা কতটুকু সে সম্পর্কে সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাধ্যবাধকতা যদি থাকেও সেক্ষেত্রে গাড়ি নষ্ট, পরিবহন শ্রমিক অসুস্থ-এমন নানা অজুহাতে কোনো মালিক যদি তার গাড়ি চালানো বন্ধ রাখে সেক্ষেত্রে বিআরটিএর কী করণীয়? জবাবে নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, আমরা এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। এখন কেউ যদি অসুস্থতার কথা বলে কিংবা তার গাড়ির ফিটনেস না থাকে বা তার গাড়ি নষ্ট থাকে, তাহলে তো তাকে চাপ দেওয়া যাবে না। তবে এটা কিন্তু বেশি দিন হওয়ার কথা নয়। আমাদের কাছে যদি মনে হয় ওই মালিক ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখছে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি অনুপযোগী গাড়ি ডাম্পিং করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র পাঁচজন। এতে অভিযান পরিচালনা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বিআরটিএর এই পরিচালক। বেসরকারি পরিবহন মালিকরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের গাড়ি বন্ধ রেখে যাত্রী দুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন। এক্ষেত্রে সরকারের বিকল্প আর কী উপায় রয়েছে তা জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বিআরটিসিকে বলেছি তারা যেন তাদের সব গাড়ি রাস্তায় নামায়। বিআরটিসি সে ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন সেবায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন-বিআরটিসির বেহাল দশা। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির মোট বাসের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৮টি। এর মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র ৮৭৯টি। সচল ৮৭৯টি গণপরিবহনের মধ্যে ঢাকায় চলাচল করে প্রায় সাড়ে ৬শ’। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ২৮ হাজার ২৬৪টি। বিশাল এই সংখ্যার কাছে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। এত স্বল্পসংখ্যক বাস নিয়ে বেসরকারি খাতের পরিবহন মালিকদের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু বিআরটিসি নিজেদের সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে না। বরং ঘটনা ঘটছে উল্টো। গত জুলাই পর্যন্ত বিআরটিসির অচল বাস ছিল ৪৯৩টি। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে অচল বাসের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৫টিতে। অথচ এই সময়ে মোট বাসের সংখ্যা একটাও বাড়েনি। এবারের সিটিং বাস বন্ধ নিয়ে সৃষ্ট অরাজকতায় কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। বিআরটিসির মাত্র ১৮টি মহিলা বাস রয়েছে। ১৫টি রুটে এই বাস চলে। অথচ ঢাকায় রুটের সংখ্যা শতাধিক। তাছাড়া এই ১৮টি বাসের মধ্যে সব নিয়মিত চলে না। ফলে নারী যাত্রীদের দুর্ভোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। সূত্র জানায়, বিআরটিসির বেশিরভাগ বাসই সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করায় অচল হয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনো বাস ২-৩ বছরের মাথায় অচল হয়ে পড়ে আছে। অচল পড়ে থাকা বাসের একটির যন্ত্রাংশ খুলে অন্যটিতে লাগানো হচ্ছে, চুরিও হচ্ছে। একসময় দেখা যায়, বাসের কাঠামো ছাড়া তাতে কোনো যন্ত্রাংশই থাকে না। আস্তে আস্তে এসব বাসই একসময় চলে যাচ্ছে মেরামত অযোগ্যের তালিকায়। আর এই তালিকায় বাসের সংখ্যা প্রায় ২শ’। বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক সকালের খবরকে বলেন, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার বিষয়ে আমরাও কিছুটা একমত। এখানে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনবল সঙ্কটের পাশাপাশি অর্থেরও অভাব রয়েছে। তারপরও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি। বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রাজধানীতে সুশৃঙ্খল গণপরিবহন চালুর জন্য ২০০৫ সালে এসটিপি (স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান) করেছিল সরকার। জনগণের টাকায় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করে সেটা তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে নৈরাজ্য বন্ধের বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা, পরামর্শের কথা বলা আছে। কিন্তু পরবর্তীতে তা যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি আরও বলেন, এসটিপি পাশ কাটিয়ে বিআরটিএ হাজার হাজার ছোট ছোট কোম্পানির লাইসেন্স দিয়েছে। কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? এখন আবার রুট পারমিট বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে। রুট পারমিট ছাড়া কত গাড়ি চলছে। তাদের কে ঠেকাবে? তিনি বলেন, গণপরিবহন একটা বিজ্ঞান। বিআরটিএর লোকজন বিভিন্ন দেশে যান। সেখান থেকে কী শিখে আসেন তারা? আসলে অপেশাদার লোকদের হাতে গণপরিবহন ছেড়ে দিলে এমন অবস্থাই হবে। অতীতেও যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল। এখনও আছে। অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে সেই ভোগান্তি বাড়বে ছাড়া কমবে না। বিআরটিএ কবিরাজের মতো কথা বলে। এই কবিরাজ দিয়ে তো সমস্যা সমাধান হবে না। তারা নিজেরাই সমস্যার কারণ। যতদিন পর্যন্ত এই ভুল ঠেকানো যাবে না। ততদিন এই অবস্থা চলতে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শামসুল হক বলেন, সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর দায় সরকারেরই। সমস্যার সমাধান করলে হবে না। পেশাদার লোক দিয়ে পরিপক্ব বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই সমাধান করতে হবে। বিআরটিসির বাসের বিষয়ে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি কোনো সেবা দিতে পারছে না। সরকারি আমলাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তারা শুধু নিজেদের পকেট ভরতে চায়। ফলে বছরের পর বছর বিআরটিসির গাড়ি কেনাকাটায় সরকারি অর্থ নষ্ট করে লাভবান হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণি। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার তাগিদ দেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর