আমি শপথ করিতেছি’ কতটা মানছি

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ দেশে বহু ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক আগে শপথ নিতে হয়। এটি অনেকের জন্যই একটি সাংবিধানিক  দায়িত্ব। আমাদের সংবিধানের ১৪৮(৩) ধারায় বলা আছে, ‘এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ এখন প্রশ্ন হলো, কী বলা হয় সেই শপথে, কী শপথ নিতে হয়? বিভিন্ন শপথে একটু-আধটু পার্থক্য থাকলেও মূল বক্তব্যটি এরকম, ‘আমি ক বা খ…সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ করিতেছি (বা ঘোষণা করিতেছি) যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি তাহা যথাযথ আইনানুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি দেশের প্রতি অনুগত থাকিব এবং সকল আইনকানুন মানিয়া চলিব। অনুকম্পা বা ক্ষোভের বশবর্তী হইয়া, অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা আমার কর্তব্য পালনকে প্রভাবিত হইতে দিব না।’ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের শপথের ভাষা প্রায় একই রকম।

এই সামান্য কয়েকটি বাক্য মুখে উচ্চারণ করতে এক-দুই মিনিট সময় প্রয়োজন হয়। এবং এই বাক্যগুলো উচ্চারণ করে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য মানুষ হেন কাজ নেই, যা করে না। কিন্তু এই বাক্যগুলো মেনে চলতে যে দৃঢ়তার প্রয়োজন, যে চিত্তের শক্তি প্রয়োজন তা কজনের থাকে? যার থাকে তিনি সহসাই পার হতে পারেন, কিন্তু যার না থাকে তার জন্য পাহাড় পার হওয়ার মতো কঠিন। যিনি এই বাক্যগুলোর মর্মার্থ উপলব্ধি করেন, ব্যক্তিগত জীবনে যার এই বাক্যগুলোর চর্চা আছে, তার জন্য এ বাক্য খুবই অর্থবহ। আর যার উপলব্ধিতে নেই, যিনি মনে করেন এটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, তিনি লক্ষবার এই বাক্য উচ্চারণ করলেও তা কোনো কাজে আসে না। সে কথাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান লেখক জ্যাক ইয়ানিয়াক তার ‘দি পানিশমেন্ট অব গডস’ শিরোনামের ফিকশন গ্রন্থে। বলেছেন, ‘শপথ গ্রহণ করে কেউ নিজেকে এক ফোঁটাও পালটাতে পারে না। কিন্তু গুনে গুনে তার সোনার পরিমাণ, সম্পদের পরিমাণ সহসাই বাড়াতে পারেন। আসলে শপথ গ্রহণ একজন মিথ্যাবাদীকে আরো বড়ো মিথ্যাবাদী বানায়। আর একজন সত্যবাদীর জন্য শপথ কোনো বিশেষ তাত্পর্য আনতে পারে না।’ অর্থাত্ একজন সত্ মানুষ শপথ নিলেও যা, না নিলেও তা। তাই বারবার আমাদের মাথায় প্রশ্ন এসে নাড়া দেয়, প্রয়োজন কি শপথ, নাকি শিশুকাল থেকে মানসিক গঠন?

পশ্চিমা দেশগুলোতে এই শপথকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ঐ দেশগুলোতে শপথ বরখেলাপ অত্যন্ত গর্হিত বলে মনে করে সেখানকার জনসাধারণ। ইউরোপ বা আমেরিকায় কেউ শপথ ভঙ্গ করেছেন প্রতীয়মান হলে তার সারা জীবনের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। আর তা পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ সামনে রেখে শপথ গ্রহণ অপরিহার্য নয়, যে-কেউ ইচ্ছা করলে পবিত্র পুস্তক ব্যবহার করে শপথের পরিবর্তে সংকল্প গ্রহণ করতে পারেন। তবে তা ঘোষণা করতে হয় একই নিয়মে (শপথ সাধারণত পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থের ওপর হাত রেখেই অধিকাংশ মানুষ করে থাকেন।) যেমন আমেরিকার ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামস ছিলেন একজন তুখোড় আইনবিদ। শুধু আইন পাশ করেননি, আইন তার কাছে ছিল ধ্যানজ্ঞান। ১৮২৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় ধর্মীয় গ্রন্থের বদলে একটি আইনের বইয়ের ওপর হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ শপথকে আরো বেশি মূল্যায়িত করতে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় গ্রন্থ ব্যবহার করেন। যেমন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৯ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় সেই পবিত্র বাইবেলটি ব্যবহার করেছিলেন যেটি ১৮৬১ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শপথ গ্রহণের সময় ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয় দফা শপথের সময় ওবামা দুটি বাইবেল ব্যবহার করেন। একটি লিংকনের ব্যবহূত আরেকটি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ব্যক্তিগত বাইবেল। হেনরি কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় একটি হিব্রু বাইবেলে (তানাখ) হাত রেখে শপথ নিয়েছিলেন। আরো মজার ঘটনা আছে ব্রিটেনের শপথ গ্রহণের ইতিহাসে। ২০০ বছর আগ পর্যন্ত সেখানে বাইবেল ছুঁয়ে শপথ করা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু পরে আইন সংশোধন করে সংকল্প গ্রহণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ এমপি চার্লস ব্র্যাডলাফ কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি তার সহকর্মীদের গায়ে হাত রেখে সংকল্প গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে ক্রেইগ হোয়াইট্যাকার বায়না ধরেন, তিনি মরমন (মরমনিজম) অনুসারীদের গ্রন্থ নিয়ে শপথ নেবেন। কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃপক্ষের কাছে সে গ্রন্থ নেই। অগত্যা তিনিও কলিগদের গায়ে হাত রেখে শপথ নেন।

তবে পশ্চিমের যেসব দেশ ধর্মপ্রবণ নয়, সেসব দেশেও সাধারণত ধর্মগ্রন্থের ওপর হাত রেখে শপথ পাঠ করা হয়। এটি বহুকালের প্রচলন হিসেবেই। এই প্রচলনের পেছনের কারণ বড়ো বড়ো ধর্মগুলোতেই শপথ গ্রহণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট শক্তিশালী নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘তুমি ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করলে তা পরিপূরণ করতে সময়ক্ষেপণ কোরো না। কারণ ঈশ্বর তোমার ওপর সে শপথের দায় দিয়েছেন। শপথের শর্ত পূরণ না করলে তুমি পাপী হবে।’

ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তাওরাতে দুটি বিষয়ে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে, ১) সেই শপথ গ্রহণ, যা পূরণ করা একজন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব এবং ২) ঈশ্বরের নাম ব্যবহার করে মিথ্যা শপথ গ্রহণ। হিন্দুধর্মের বেদ ও উপনিষদে শপথ সম্পর্কে যে সতর্ক করা হয়েছে তা-ই শুধু নয়, মহাভারত ও রামায়ণে শপথ গ্রহণ ও ভঙ্গের ব্যাপারে বহু জীবনস্পর্শী কাহিনির মাধ্যমে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনেও আছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। সুরা আল মায়েদার ৮৯ আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘আল্লাহ তোমাদের দায়ী করেন না অনর্থক শপথের জন্য। কিন্তু ঐ শপথের জন্য দায়ী করেন, যা তোমরা গুরুত্বের সঙ্গে করো।’

কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্য আমাদের। শপথ বোধ করি এতটা অর্থবহ নয় আমাদের দেশে। এই সমাজে প্রকাশ্যে দায়িত্বশীলরা শপথ ভঙ্গ করছেন অহরহ। কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর হলো, সমাজের মানুষ সেই শপথ ভঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। যেন এটাই স্বাভাবিক! শপথ ভঙ্গের কারণে কারো পরবর্তী নির্বাচনে ভোট পাওয়া আটকায় না, শপথ ভঙ্গের জন্য কারো চাকরি যায় না, শাস্তি হয় না। কখনো কখনো এই শপথ ভঙ্গ চলছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। শপথ নেওয়া কতটা গুরুত্বহীন তার একটি উদাহরণ দিই। দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে সরকারি কাজে প্রবেশের আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই প্রশিক্ষণ শেষে বের হয়ে আসার সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ধর্মীয় পবিত্র সামনে রেখে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। সেই শপথ অনুষ্ঠানে (কেউ কেউ) প্রশিক্ষকদের ঘুষ দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করেন, যাতে তাকে পবিত্র গ্রন্থের সামনে দাঁড়াতে না হয়। অতঃপর উেকাচের বিনিময়ে শপথের সময় শপথগ্রহণকারী পবিত্র গ্রন্থ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। তারপর তিনি ধরে নেন, যাক, যেহেতু পবিত্র গ্রন্থকে সাক্ষী করিনি, সেহেতু আমার শপথটি হয়নি! এখন চাকরিতে গিয়ে যা খুশি করা যাবে। বড়োসংখ্যক রিক্রুটমেন্টের এই একাডেমিতে আগে এই পদ্ধতির জন্য জনপ্রতি ৫০ টাকা দিতে হতো। পরে তা হয়েছিল ১ হাজার টাকা। এই মুহূর্তে কী অবস্থা জানা নাই। এখন এই জঘন্য ‘শপথ’ ব্যবস্থা নেই আশা করি। আবার নির্ভুল ভাষায় শপথ যারা গ্রহণ করেন, তারাও যে শপথ মেনে চলেন বিষয়টা কিন্তু তা নয়।

রাজনীতিবিদরা হলেন সমাজের আয়না। তাদের দিকে তাকালেই সমাজের পুরো চিত্র ফুটে ওঠার কথা। রাজনীতিবিদদের একটি বড়ো অংশকে আমরা প্রায়ই হাটে-মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে শপথ ভাঙতে দেখি। জনগণও নির্বিকার। রাজনীতিবিদ শপথ ভাঙছেন, আবার সময়মতো গিয়ে শপথ নিচ্ছেন। জনগণেরও কোনো বিকার নেই। কাউকে কখনো আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায় না, ‘দেখেছেন! তিনি শপথ নিয়ে কীভাবে শপথ ভঙ্গ করলেন!’ বরং বলতে শোনা যায়, ‘একা খেয়ে ফেলল! কয়েক জন সাগরেদকে নিয়ে খেয়ে ফেলল!’ আর এই অভিযোগের অন্তরে নিজে না পাওয়ার একটি সূক্ষ্ম বেদনা অনুরণিত হতে থাকে।

সুতরাং আজ আমরা সমাজের যে চিত্র দেখি, তা মূল্যবোধের অভাবের পরিণতি। একটি শিক্ষিত সমাজকে কোনোদিন একজন বা কয়েকজন অশিক্ষিত ব্যক্তি করতলগত করে রাখতে পারে না। একটি সভ্য সমাজকে কোনোদিন একজন বা কয়েক জন অসভ্য ব্যক্তি হাতের মুঠোয় আটকে রাখতে পারে না। সুতরাং আজকের পচনশীল অবস্থার জন্য সমাজের দায়ও কম নয়। এদেশে ভালো রাজনৈতিক নেতা আছে, ভালো সরকারি কর্মকর্তা আছে এবং ভালো মানুষও আছে। কিন্তু সংখ্যাটা এত কমে গেছে তাদের চোখে দেখা যায় না, তাদের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায় না।

লেখক: মহসীন হাবিব

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর