নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও সম্পদের মালিক হয়েছেন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের প্রত্যেকের রয়েছে দামি গাড়ি ও ঢাকায় বাড়ি। কারও কারও আছে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস। গত তিন মাসে এই চক্রের ব্যাংক হিসাবে কমবেশি ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এরই মধ্যে তাঁদের সবার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে ছয়জনই পিএসসিতে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদের কর্মকর্তা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও। তাঁরা এক যুগ ধরে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জন গতকাল সন্ধ্যায় দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি ১১ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
পিএসসির গ্রেপ্তার তিন কর্মকর্তার মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম হোতা সিলেট বিভাগীয় অফিসের উপপরিচালক (ডিডি) জাহাঙ্গীর আলম। এই কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ভরানীগঞ্জে। নিজ এলাকায় বিপুল সম্পদের মালিক তিনি; পাশাপাশি ঢাকায়ও রয়েছে তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ডি ব্লকের ১ নম্বর সড়কের ৮/ও নং বাড়ির তৃতীয় তলায় ২ হাজার বর্গফুটের বেশি একটি সুসজ্জিত আধুনিক ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। এই ফ্ল্যাট থেকেই তাঁকে ৭ জুলাই রাতে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুর ও ভাটারায় তাঁর একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। এই কর্মকর্তার তিনটি ব্যাংকে অন্তত ১৩ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। ৫ জুলাই রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই সময়ও তাঁর অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়।
সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার পিএসসির অপর উপপরিচালক মো. আবু জাফরের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া এলাকায়। তিনি ঢাকার আজিমপুরে সরকারি কলোনিতে পরিবার নিয়ে বাস করলেও তাঁর নামে মোহাম্মদপুরের তিনরাস্তা এলাকায় প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে। মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায় জ্যোতি কমার্শিয়াল সেন্টার নামের কোচিং সেন্টার রয়েছে তাঁর। সেখানে চাকরির কোচিংয়ের আড়ালে ফাঁস করা প্রশ্নের কেনাবেচার কারবার ও নিয়োগ-বাণিজ্যের চুক্তি করেন তিনি। এই কর্মকর্তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
আবু জাফরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে প্রায় ৬০ শতাংশ জমির ওপর একটি ডুপ্লেক্সের নির্মাণকাজ চলমান রেখেছেন তিনি। বাড়ির দরজায় একটি মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
মিয়া বাড়ি হাফিজিয়া লিল্লাহ বোর্ডিং মাদ্রাসা নামের ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ইমরান হোসেন বলেন, ‘মসজিদ মাদ্রাসা তাঁদের, এখানে যত খরচ জাফর মিয়া ও তাঁর ভাই আউয়াল মিয়া চালান।’
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক মৃধা বলেন, ‘আমরা জানি, জাফর মিয়া সচিবালয় চাকরি করে, ভালো টাকাপয়সা আছে। এহানে একটা বাড়ি বানাইতেছে আর মসজিদ মাদ্রাসা করছে। তয় এখানে তেমন আসে না।’
অভিযুক্ত পিএসসির আরেক কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির। তাঁর গ্রামের বাড়ি নওগাঁর বদলগাছীর কোলাহাট এলাকায়। রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের সরকারি বাসভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। তাঁরও মিরপুরে চাকরির কোচিং সেন্টার রয়েছে। ওই কোচিং সেন্টারে যাঁরা কোচিং করতেন, তাঁদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিতেন এই কর্মকর্তা। তাঁর কাছেও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মিলেছে।
পিএসসির গ্রেপ্তার হওয়া ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমানের গ্রামের বাড়ি যশোরের কেশবপুরের বড়েঙ্গায় নিম্নপদে চাকরি করলেও ঢাকায় দামি ফ্ল্যাট ও গাড়ি আছে তাঁর। গত ৬ বছরে এসব সম্পদ করেছেন খলিল। রাজধানীর মিরপুরের ৬০ ফিটের পরমাগলিতে তাঁর ফ্ল্যাট আছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির আরেক কর্মচারী সাজিদুল ইসলাম এক যুগের বেশি অফিস সহকারীর কাজ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চরজব্বার থানার চরবাটা এলাকায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম হোতা এই সাজিদুল। তাঁর ভাই ও বোনের স্বামী বিসিএস ক্যাডার। তাঁর বাবাও সরকারি পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। সাজিদুল মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। নোয়াখালীতে তিনি নতুন বাড়ির কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
তবে সবচেয়ে বেশি যাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তিনি হলেন পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক আবেদ আলী পিএসসির অন্তত তিনজন চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন। ঢাকায় ফ্ল্যাট, রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা, হোটেল ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে তাঁর। কয়েক বছর আগে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ধরা পড়ে চাকরিচ্যুত হন। তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে গত সোমবার তাঁকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গ্রেপ্তার ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ
পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের গ্রেপ্তার ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল এ বিষয়ে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আদালতে ৬ জনের দায় স্বীকার
গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে ৬ জন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন আবেদ আলী, পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, ডেসপাস রাইডার সাজেদুল ইসলাম, পানি ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, সাখাওয়াতের ভাই সাইম হোসেন এবং ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী লিটন সরকার।
অন্যদিকে অপরাধ স্বীকার না করা ১১ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। তাঁরা হলেন ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের আবাসন ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, পিএসসির ডিডি আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, এডি এস এম আলমগীর কবীর, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের মুদ্রাক্ষরিক মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল কলেজের টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্ত হবে। সেখানে অবৈধ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেলে অর্থ পাচারের মামলার সুপারিশ করা হবে।