বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ করোনা আক্রান্ত বিশ্ব, নাস্তানাবুদ স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে যখন উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ ঠিক সেই মুহূর্তে এই মহামারী গোটা অর্থনীতির ওপর চরম আঘাত হানল। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান দুদিক বিবেচনাতেই কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
কৃষি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি বিবেচনা করি, তাহলে বলা যায় মহামারীর প্রভাবে একদিকে যেমন খাদ্য সরবরাহের যে শৃঙ্খল সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে খাদ্যের চাহিদার যে প্যাটার্ন সেটিও অনেকাংশে পরিবর্তিত রূপ ধারণ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মপন্থা হাতে নিয়েছে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন, দাম ও বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখা প্রতিটি সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। এর মধ্যে আছে চাল, আটা, ময়দা, ডিম, শাকসবজি ইত্যাদি। অন্যদিকে মাছ, মাংস, ফলমূল এসবের চাহিদা কিছুটা নিম্নমুখী। এর কারণ একদিকে কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, অন্যদিকে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মানুষজন বহুমুখী খাদ্যাভ্যাস সীমিত পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ভাত। চালের দামের রাজনৈতিক প্রভাবও খুব শক্তিশালী। চালের সঠিক সরবরাহ থাকলে এবং এর দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকলে দেশের সরকারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। করোনাকালীন দুঃসময়ে চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে বলা যায়। বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ বহুল প্রচলিত দুটি জাতের চাল আপাতদৃষ্টিতে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলনও হয়েছে এবং ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ের সুবিধার্থে সরকার ধান-চাল কেনার কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে।
এমতাবস্থায় চাল আমদানির সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত সেটি ভেবে দেখার বিষয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মিলাররা সরকারের নির্ধারিত ৩৬ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করতে রাজি না হওয়ার ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অর্থাৎ করোনাকালীন দেশ যেন খাদ্য ঘাটতিতে না পড়তে হয়, সে জন্য এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। এবার কিছুটা অন্যান্য খাদ্যের দিকে নজর ফেরানো যাক। শাকসবজির চাহিদা এই করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। রবি মৌসুম বিভিন্ন প্রকার শাকসবজির প্রাপ্যতার একটি সর্বোৎকৃষ্ট সময়।
কিন্তু রবি মৌসুমের সরবরাহ শেষ হওয়ার পর থেকে ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে শাকসবজির দাম, বিশেষ করে কাঁচামরিচের দামের ঝালে ভোক্তাদের এখন বেহাল দশা। যাদের বাড়ির আঙিনায় খোলা জায়গা রয়েছে, তারা যদি সেসব জায়গায় শাকসবজির চাষ করেন এবং নগরগুলোর ছাদ কৃষির প্রচলন পরিবারভিত্তিক শাকসবজির যে চাহিদা সেটা কিছুটা হলেও পূরণে সক্ষম হবে। করোনাকালীন অনেকেই এভাবে শখের কৃষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।
করোনাকালে ও এর পরবর্তী সময়ে যাতে দেশের মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে এবং সে অনুযায়ী যেন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, সে জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে নিরাপদে দ্রুত ফসল কর্তন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বিভিন্ন ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদে ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, কৃষিপণ্য পরিবহন, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রথমে আসা যাক উৎপাদনের কথায়। আশার কথা এই যে, করোনা এখন পর্যন্ত সেভাবে খাদ্য উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে বাড়তে থাকে, যা রবি বা বোরো ফসল সংগ্রহে বাধার সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি সবকিছুই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে।
করোনার এই আপৎকালে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে আম্ফান ঘূর্ণিঝড় এবং চলমান বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গত ২০ মে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত হানে। এই আঘাত প্রথমে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় আক্রমণ করে পরবর্তী সময়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিম এলাকাসহ মোট ৪৩টি জেলায় আঘাত করে।
এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজন। তবে ঘূর্ণিঝড়ের আগেই সারাদেশের ৭২ শতাংশ বোরো ধান কর্তন হয়ে যাওয়ার ফলে প্রচলিত খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এটি তেমন হুমকি না হলেও অন্যান্য ফসল ও ফলচাষিদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা ছিলো। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও মসলাচাষিদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমন মৌসুমে বিনামূল্যে সার, বীজ, নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
করোনা মহামারী আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিলো যে, কৃষির যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিক সংকট যে কোনো ফসলের লাভজনকতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া জলবায়ুর বিভিন্ন প্রভাব এড়াতেও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কম উৎপাদন খরচে স্বল্প সময়ে স্বল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব। সরকার সম্প্রতি কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, ড্রায়ার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পটেটো ডিগারসহ বিভিন্ন প্রকার প্রায় ৫২ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে। এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায় এবং কৃষির আধুনিকায়নের পথে দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে।
এছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকির সুবিধা রয়েছে, যা কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যায়। করোনা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে ১ হাজার ৩২২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৯০৮টি রিপার বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। তবে দেশের মোট চাহিদার তুলনায় এগুলো অবশ্যই পর্যাপ্ত নয়। এ জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের দেশের ক্ষুদ্র আকৃতির জমির জন্য প্রযোজ্য মেশিন দেশীয়ভাবে তৈরির প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণে ই-কমার্স একটি নতুন ব্যাপক প্রসার দেখা গেছে।করোনাকালে এরইমধ্যে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য অনলাইনে সফলতা পেয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সবজিসহ আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আনারস, সুগন্ধি চাল ইত্যাদি ভোক্তাসাধারণের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছে। ভবিষ্যতে কৃষিপণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
উদ্যোক্তা হিসেবে করোনাকালে কৃষিপণ্যের আমদানি-রফতানি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করে তাদের প্রণোদনা দেয়া উচিত।
উন্নত ও আধুনিক কৃষিই পারবে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে। উন্নত ও আধুনিক কৃষিতে রূপান্তরিত করাসহ কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারলে দুর্যোগ মোকাবিলা সহজ হবে।