ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্ষমা করবেন স্যার

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্যাতিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে পুনর্বহাল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি নির্যাতকের ভূমিকায় থাকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি (এসএমসি) বাতিল করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, কাল্পনিক অভিযোগে শ্যামলকে বহিষ্কার করায় বিদ্যালয়টির এসএমসি বিলুপ্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে নতুন এসএমসি গঠন করা হয়েছে। তারা আপাতত বিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নির্যাতিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। পাশাপাশি তাকে নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, তাকে মারধর করে চাকরিচ্যুতির স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নিজেই নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বলে জানান এ শিক্ষক।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ রটিয়ে ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণদি এলাকায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে সবার সামনে কান ধরে উঠবোস করিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও সেলিম ওসমান দাবি করছেন, শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করায় এলাকাবাসী তার ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। জনতার রোষ থেকে শিক্ষককে বাঁচাতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এখানেই ঘটনা থেমে থাকেনি। শ্যামলকে ১৩ মে অনুষ্ঠিত বিদ্যালয়ের এসএমসিতে বরখাস্ত করা হয় বলে এ সংক্রান্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। যদিও শ্যামল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ মে ওই চিঠি হাতে পান।

এ ঘটনার ভিডিও এবং সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি অন্যান্য স্থানে গত কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, শোবিজ জগতের মানুষরা অসন্তোষ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলনিশি জারি করেছেন। খোদ শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, ১৪ দল বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একাধিক শিক্ষক সংগঠন মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে। ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে এক ঘণ্টা মানববন্ধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধনে শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘আমরা স্তম্ভিত, মর্মাহত। শ্যামল কান্তি ভক্তের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা করবেন স্যার।’

শিক্ষক লাঞ্ছনা প্রকাশ পেলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশে ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক ইউসুফ আলীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বুধবার রাতে ওই কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কমিটি শিক্ষক শ্যামল কর্তৃক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি বা কোনো ধরনের অবমাননাকর মন্তব্যের প্রমাণ পায়নি। বরং স্কুল পরিচালনা প্রবিধানমালায় দেয়া এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষককে দেয়া চিঠিতে গত ১৩ মে স্কুল পরিচালনা কমিটির বৈঠকে শিক্ষককে বরখাস্তের কথা বলা হয়। ওই চিঠিতে স্কুল সভাপতি ফারুকুল ইসলাম ১৬ মে স্বাক্ষর করেন। অথচ সভাপতি ১৪ মে ভারত সফরে গেছেন বলে কমিটি জানতে পেরেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বরখাস্তের আদেশের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত কমিটি স্থানীয় ও ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী, স্কুলের শিক্ষক, সংশ্লিষ্ট ছাত্র রিফাতসহ (৮ মে স্কুলের দশম শ্রেণীর যে ছাত্র শ্যামল শাসন করেছিলেন) আরও কয়েকজন ছাত্রের বক্তব্য ও সাক্ষ্য নেয়। কমিটি শিক্ষককে বরখাস্ত করা সংক্রান্ত বৈঠকের এজেন্ডা ও রেজুলেশন নিরীক্ষা করে। এই তদন্ত রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতেই মন্ত্রণালয় শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহাল এবং এসএমসি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়; যা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার সকালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান শিক্ষকদের সম্মেলন চলছিল মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কাল্পনিক। তার বহিষ্কার বেআইনি। তিনি বলেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম নিয়ে কটূক্তির’ অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পায়নি সরকারি তদন্ত কমিটি। বরং তাকে অন্যায়ভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ সময় তিনি সভ্য সমাজে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করে বলেন, যে বৈঠকে শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে, সে বৈঠকে এ নিয়ে কোনো এজেন্ডা ছিল না। অন্য বিষয়ে আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার কথাটি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র রিফাতের কথা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনতাকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো করা হয়। অথচ সেই ছাত্র রিফাতই পরে বলেছে, ধর্ম নিয়ে ওই শিক্ষক কোনো কটূক্তি করেননি। এ বিষয়ে রিফাতের বক্তব্য, তার স্যার তাকে মারধর করায় সে এর বিচার চাইতে স্কুলের কমিটির কাছে গিয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এই ঘটনা থেকে তদন্ত কমিটি ধারণা করছে, এসএমসির কিছু সদস্যের আগে থেকে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের শিকার হয়েছেন শ্যামল। যে কারণে এই এসএমসিই ভেঙে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন মোটা দাগে যে ক’টি সুপারিশ করেছে, তারই আলোকে মন্ত্রী মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে দুটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। কমিটি শিক্ষক কর্তৃক ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কোনো প্রমাণ পায়নি। এর বাইরে আর কোনো ফাইন্ডিংস নেই।’

সারা দেশে প্রতিবাদ, কর্মসূচি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন আলাদা কর্মসূচি পালন করেছে।

জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট : সরকারপন্থী শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় এই মোর্চার ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ খানপুর সরকারি হাসপাতালে সাক্ষাৎ করেন। তারা তাকে সহমর্মিতা জানিয়েছেন এবং লাঞ্ছনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ কারিগরি কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) মো. মহসীন রেজা। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি শ্যামলকে চাকরিতে পুনর্বহালে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, এর দ্বারা ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লাঞ্ছিত শিক্ষকের পুনর্বহাল ও ম্যানেজিং কমিটি বাতিল ঘোষণা করায় ফ্রন্ট শিক্ষামন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে নির্যাতিতের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, মিডিয়াসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।

ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিনব প্রতিবাদ : নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় কান ধরে অভিনব প্রতিবাদ করেছেন ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কান ধরে ১০ মিনিট অবস্থান নেন তারা। এতে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অবস্থান কর্মসূচি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, ‘শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে আমরা প্রতীকী অবস্থান নিয়েছি। এ ধরনের ঘটনা পুরো জাতির লজ্জা। আমি এর দ্রুত বিচার দাবি করছি।

আদালতের তদন্তের নির্দেশ

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনা তদন্তে পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন আদালত। বন্দর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে কান ধরে উঠবোসের ঘটনাকে ‘মানহানিকর অপরাধ’ বিবেচনায় তদন্তের আবেদন করলে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্ত অনুমতি দেন। নারায়ণগঞ্জের কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান জানান, গত ১৩ মে বিকালে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণদি এলাকায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সবার সামনে কান ধরে উঠবোস করেন। তিনি আরও জানান, এ ঘটনাকে মানহানিকর অপরাধের আওতায় এর তদন্তের জন্য বন্দর থানার এসআই মোখলেছুর রহমান আদালতে আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে অপরাধ তদন্তের নির্দেশ দেন। হাবিবুর রহমান বলেন, মানহানিকর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আসামিকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড এমনকি উভয় দণ্ড দেয়া হয়ে থাকে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

ক্ষমা করবেন স্যার

আপডেট টাইম : ০৫:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ মে ২০১৬
নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্যাতিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে পুনর্বহাল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি নির্যাতকের ভূমিকায় থাকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি (এসএমসি) বাতিল করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বলেন, কাল্পনিক অভিযোগে শ্যামলকে বহিষ্কার করায় বিদ্যালয়টির এসএমসি বিলুপ্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে নতুন এসএমসি গঠন করা হয়েছে। তারা আপাতত বিদ্যালয় পরিচালনা করবেন।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নির্যাতিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। পাশাপাশি তাকে নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, তাকে মারধর করে চাকরিচ্যুতির স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নিজেই নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত বলে জানান এ শিক্ষক।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ রটিয়ে ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণদি এলাকায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে সবার সামনে কান ধরে উঠবোস করিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও সেলিম ওসমান দাবি করছেন, শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করায় এলাকাবাসী তার ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। জনতার রোষ থেকে শিক্ষককে বাঁচাতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এখানেই ঘটনা থেমে থাকেনি। শ্যামলকে ১৩ মে অনুষ্ঠিত বিদ্যালয়ের এসএমসিতে বরখাস্ত করা হয় বলে এ সংক্রান্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। যদিও শ্যামল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ মে ওই চিঠি হাতে পান।

এ ঘটনার ভিডিও এবং সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি অন্যান্য স্থানে গত কয়েকদিন ধরে সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, শোবিজ জগতের মানুষরা অসন্তোষ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলনিশি জারি করেছেন। খোদ শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, ১৪ দল বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একাধিক শিক্ষক সংগঠন মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে। ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে এক ঘণ্টা মানববন্ধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধনে শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘আমরা স্তম্ভিত, মর্মাহত। শ্যামল কান্তি ভক্তের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা করবেন স্যার।’

শিক্ষক লাঞ্ছনা প্রকাশ পেলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্দেশে ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক ইউসুফ আলীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বুধবার রাতে ওই কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কমিটি শিক্ষক শ্যামল কর্তৃক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি বা কোনো ধরনের অবমাননাকর মন্তব্যের প্রমাণ পায়নি। বরং স্কুল পরিচালনা প্রবিধানমালায় দেয়া এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষককে দেয়া চিঠিতে গত ১৩ মে স্কুল পরিচালনা কমিটির বৈঠকে শিক্ষককে বরখাস্তের কথা বলা হয়। ওই চিঠিতে স্কুল সভাপতি ফারুকুল ইসলাম ১৬ মে স্বাক্ষর করেন। অথচ সভাপতি ১৪ মে ভারত সফরে গেছেন বলে কমিটি জানতে পেরেছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বরখাস্তের আদেশের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তদন্ত কমিটি স্থানীয় ও ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী, স্কুলের শিক্ষক, সংশ্লিষ্ট ছাত্র রিফাতসহ (৮ মে স্কুলের দশম শ্রেণীর যে ছাত্র শ্যামল শাসন করেছিলেন) আরও কয়েকজন ছাত্রের বক্তব্য ও সাক্ষ্য নেয়। কমিটি শিক্ষককে বরখাস্ত করা সংক্রান্ত বৈঠকের এজেন্ডা ও রেজুলেশন নিরীক্ষা করে। এই তদন্ত রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতেই মন্ত্রণালয় শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহাল এবং এসএমসি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়; যা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেন শিক্ষামন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার সকালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান শিক্ষকদের সম্মেলন চলছিল মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের বন্দরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কাল্পনিক। তার বহিষ্কার বেআইনি। তিনি বলেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম নিয়ে কটূক্তির’ অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পায়নি সরকারি তদন্ত কমিটি। বরং তাকে অন্যায়ভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ সময় তিনি সভ্য সমাজে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করে বলেন, যে বৈঠকে শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে, সে বৈঠকে এ নিয়ে কোনো এজেন্ডা ছিল না। অন্য বিষয়ে আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি।

প্রসঙ্গত, শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার কথাটি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র রিফাতের কথা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনতাকে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো করা হয়। অথচ সেই ছাত্র রিফাতই পরে বলেছে, ধর্ম নিয়ে ওই শিক্ষক কোনো কটূক্তি করেননি। এ বিষয়ে রিফাতের বক্তব্য, তার স্যার তাকে মারধর করায় সে এর বিচার চাইতে স্কুলের কমিটির কাছে গিয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এই ঘটনা থেকে তদন্ত কমিটি ধারণা করছে, এসএমসির কিছু সদস্যের আগে থেকে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের শিকার হয়েছেন শ্যামল। যে কারণে এই এসএমসিই ভেঙে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন মোটা দাগে যে ক’টি সুপারিশ করেছে, তারই আলোকে মন্ত্রী মহোদয় সংবাদ সম্মেলনে দুটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। কমিটি শিক্ষক কর্তৃক ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কোনো প্রমাণ পায়নি। এর বাইরে আর কোনো ফাইন্ডিংস নেই।’

সারা দেশে প্রতিবাদ, কর্মসূচি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেন। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন আলাদা কর্মসূচি পালন করেছে।

জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট : সরকারপন্থী শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় এই মোর্চার ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল লাঞ্ছিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ খানপুর সরকারি হাসপাতালে সাক্ষাৎ করেন। তারা তাকে সহমর্মিতা জানিয়েছেন এবং লাঞ্ছনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ কারিগরি কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) মো. মহসীন রেজা। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি শ্যামলকে চাকরিতে পুনর্বহালে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছে, এর দ্বারা ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লাঞ্ছিত শিক্ষকের পুনর্বহাল ও ম্যানেজিং কমিটি বাতিল ঘোষণা করায় ফ্রন্ট শিক্ষামন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে নির্যাতিতের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, মিডিয়াসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।

ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিনব প্রতিবাদ : নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় কান ধরে অভিনব প্রতিবাদ করেছেন ঢাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কান ধরে ১০ মিনিট অবস্থান নেন তারা। এতে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অবস্থান কর্মসূচি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, ‘শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে আমরা প্রতীকী অবস্থান নিয়েছি। এ ধরনের ঘটনা পুরো জাতির লজ্জা। আমি এর দ্রুত বিচার দাবি করছি।

আদালতের তদন্তের নির্দেশ

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবোস করানোর ঘটনা তদন্তে পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন আদালত। বন্দর থানা পুলিশের পক্ষ থেকে কান ধরে উঠবোসের ঘটনাকে ‘মানহানিকর অপরাধ’ বিবেচনায় তদন্তের আবেদন করলে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্ত অনুমতি দেন। নারায়ণগঞ্জের কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান জানান, গত ১৩ মে বিকালে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যাণদি এলাকায় পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সবার সামনে কান ধরে উঠবোস করেন। তিনি আরও জানান, এ ঘটনাকে মানহানিকর অপরাধের আওতায় এর তদন্তের জন্য বন্দর থানার এসআই মোখলেছুর রহমান আদালতে আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে অপরাধ তদন্তের নির্দেশ দেন। হাবিবুর রহমান বলেন, মানহানিকর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আসামিকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড এমনকি উভয় দণ্ড দেয়া হয়ে থাকে।