বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হলেও অনেকেরই কৃষির অন্যতম উপাদান কৃষি জমি নেই। কৃষকদের অধিকাংশই বর্গা ও প্রান্তিক চাষি। এ বর্গা ও প্রান্তিক চাষিরা যা উৎপাদন করেন, তা থেকে জমির মালিকের অংশ দেওয়ার পর যা থাকে, তার সঠিক দাম পান না। তাই পরবর্তী বছর আর বর্গায় জমি চাষ না করে শহরমুখী হন। অথচ উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সঠিক দাম পেলে তাঁদের কেউ শহরমুখী হওয়ার চিন্তা করতেন না।
একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, কৃষকের উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পান, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু কোন সরকার এ বিষয়ে কতটা মাথা ঘামিয়েছে, তা কৃষকমাত্রই জানেন। সরকার যদি কৃষকের লাভ-লোকসান নিয়ে সত্যিই ভাবতেন, তাহলে প্রতিবছর কৃষককে ধান আর পাট বিক্রি করে লোকসান ও ঋণের বোঝা বহন করতে হতো না। বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, প্রতিবছর তারা প্রতারিত হন এবং একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই ভিড় জমান শহরে।
ফসল ফলিয়ে প্রতিবছর যতসংখ্যক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এনজিওদের আগ্রাসনে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুদের চাপে কত কৃষক, জেলে, মজুর যে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমান, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা না থাকলেও শহরে বস্তির আধিক্য দেখে এর কিছুটা অনুমান করা যায়। বলা যায়, দেশের প্রতি ১০ জন লোকের একজন ঢাকায় বাস করেন। এরা সবাই যে প্রয়োজনে ঢাকা এসে ভিড় করে এমন নয়, অনেকে বাধ্য হয়ে শহরে আসে। এ জাতীয় শহরবাসীর জন্য গ্রামে আয়-রোজগারের ব্যবস্থা থাকলে তাদের অনেকেই গ্রামে ফিরে নিজের ও দেশের উন্নয়নে কাজ করতেন।
গ্রামীণ চাহিদা মেটাতে স্থানীয় অনেক পণ্য তৈরি হচ্ছে গ্রামে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। বিকশিত হচ্ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির সুযোগ। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা। ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অন্যের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আজ গ্রামীণ অর্থনীতিতে পেশা বাছাইয়ে বহুমুখিতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু একসময় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান কমে আসায় অনেকে ধারণা করেছিল, অর্থনীতিতে গ্রামের অবদান বোধ হয় কমে আসবে। সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রামই থেকে গেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই বিকাশÑঅর্থনীতির সার্বিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে। এ অবস্থায় গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে কৃষিতে বাড়াতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার। জোরদার করতে হবে গবেষণা। বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও চাঙা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, সরকারের সাত বছর মেয়াদি কৃষি উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৭১ কোটি ৪ লাখ এবং তিন উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থার ঋণ ও অনুদান থেকে ১ হাজার ৬০৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এসবে কি কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন? নামমাত্র সুদে ঋণ পাবেন? গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে যে কৃষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁকে রক্ষার্থে কি প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকি দেবে?
এ ক্ষেত্রে অবশ্যই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর দুর্বল গ্রামীণ অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় খামার ও কৃষিভিত্তিক আয় বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট বাধাগুলো অপসারণ করতে হবে। সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলার কৃষকদের কৃষি ভর্তুকি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধনমূলক কর্মসংস্থান, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনের জন্য সহজ শর্তে মূলধন জোগান নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলোয় ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় বিশেষ সুবিধাদি প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ বিবেচনায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম সুদে তহবিল প্রদান করতে হবে। ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাহীন এবং নদীভাঙা পরিবারকে সরকারি খাসজমিতে পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সবকিছু যদি যথাযথভাবে হয়, তবু সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের দাম। এ জন্য যেখানে যে কৃষিপণ্য বেশি হয়, সেখানে সে ধরনের কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে তুলতে হবে। তাতে বেকার সমস্যা দূর হবে, কৃষক পণ্যের সঠিক দাম পাবেন এবং শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে। অবশ্য গ্রামীণ অর্থনীতির গতি বাড়াতে, ব্যবসা ও শিল্পের বিকাশ আরও ত্বরান্বিত করতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে হবে। তবেই উন্নয়নের চালিকাশক্তি গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত হবে।