বিএনপি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে আইনের আওতায় আনা, হাইকোর্ট বিভাগে দলীয় নিয়োগ পাওয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ মোট ২২ দফা দাবি জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী চেয়েছে সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য দুটি রোডম্যাপ।
গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের সঙ্গে সংলাপে এসব প্রস্তাব ও দাবি জানানো হয়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টির সংলাপ হয়। সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ, আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
ঘণ্টাখানেক সংলাপে রাষ্ট্র সংস্কারসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলেন বিএনপি নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন হচ্ছে তাঁদের ১ নম্বর অগ্রাধিকার। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির দাবিগুলো জনগণের এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও দাবি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অত্যন্ত ভালো পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। প্রধানত নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমরা নির্বাচন বিষয়ে কথা বলেছি। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে বলেছি। আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত অধ্যাদেশ দিয়ে বাতিল করতে বলেছি। বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যেন কখনো নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে না যায়, সেটা আমরা বলেছি। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় ভুয়া ভোটের মাধ্যমে হওয়া সব ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করতে বলেছি। সেই সঙ্গে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের সময় যাঁরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশনার ছিলেন তাঁদেরসহ ভুয়া ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেছি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রায় দুই মাস হতে চলেছে, কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের যাঁরা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তাদের দোসর হয়ে লুটপাট, অনাচার, অত্যাচার, গুম-খুন, গণহত্যায় সহায়তা করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখনো বহাল তবিয়তে নিজ নিজ জায়গায় আছেন। অবিলম্বে তাঁদের সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের আনার কথা বলেছি আমরা।’
জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া জানতে চেয়েছেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাঁদের নিয়োগ আমরা বাতিল করতে বলেছি। সেই সঙ্গে যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা করতে বলেছি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘১৫ বছর ধরে যেসব সরকারি কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত রয়েছেন, তাঁদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিশ্চিত করার কথা বলেছি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘হাইকোর্ট বিভাগে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ হাইকোর্ট বিভাগের বেশির ভাগ নিয়োগই ছিল দলীয় ভিত্তিতে। সেখানে এখনো প্রায় ৩০ জন বিচারক বহাল তবিয়তে কাজ করছেন। তাঁদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমরা বলেছি। কিছু দলকানা বিচারক আছেন, তাঁদের অপসারণের কথা বলেছি। অতি দ্রুত আমরা পিপি ও জিপি নতুন নিয়োগ করার কথা বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, যাদের দুর্নীতি-হত্যার মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটা আমরা দেখার জন্য বলেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত করা সব মিথ্যা, গায়েবি, ভুয়া, সাজানো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কিছু আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন; কিভাবে পালাচ্ছেন, কার সহযোগিতায় পালাচ্ছেন, সে বিষয়গুলো আমরা দেখার জন্য বলেছি। ফ্যাসিবাদী প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। ভারতে অবস্থানের কারণে তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর মাধ্যমে অপপ্রচার চলছে। এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এবং তাঁকে ওই অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে তা-ও বলেছি। গুম-খুনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের মধ্যে একমাত্র জিয়াউল হাসান ছাড়া আর কাউকেই ধরা হয়নি। অবিলম্বে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা, যাঁরা ওই অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সহযোগিতা করছেন না—এ বিষয়টিও প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। পূজাকে কেন্দ্র করে সনাতনি ধর্মের কিছু মানুষ, সবাই না—অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, নির্যাতন হচ্ছে, যেটা সর্বৈব মিথ্যা। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে—এটা বলা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে বলেছি অন্তর্বর্তী সরকারকে।’
জামায়াত চায় দুটি রোডম্যাপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সংলাপ শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেন জামায়াত নেতারা। সংলাপে জামায়াতের পক্ষ থেকে সংস্কারকে ১ নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয় বলে জানান শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের সময় কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুটি বিষয় চেয়েছি, একটি রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। দুটি বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, ‘৯ অক্টোবর আপনাদের মাধ্যমে সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাবগুলো আমরা জাতির সামনে উন্মুক্ত করব।’
এই সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তারা এসেছে বলেও মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাজ হচ্ছে গত তিনটি নির্বাচনে জাতি বঞ্চিত হয়েছে—সে ক্ষেত্রে একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এ জন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তারা সংস্কার করবে—সংলাপে আমরা সেই বিষয়ে কথা বলেছি।’
শফিকুর রহমান জানান, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপে কথা হয়েছে। জনগণ ও সরকার একসঙ্গে কিভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো উন্নত করতে পারে; সব ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে—সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, বর্তমান যে সরকার আছে, তারা কোনো ধরনের পক্ষ-বিপক্ষের মানসিকতা না নিয়ে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে একটা ভালো পর্যায়ে নিয়ে নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে।’
জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম, সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে? এটা নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করব। এটা নিয়ে দেরি হবে না। এভাবে আমরা সামনে আগাতে চাই। দুর্গাপূজায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার জন্য করণীয় বিষয়েও আলোচনা করেছি।’
শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলনের দাবি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেয়। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ।
দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংলাপে দলের আমির প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনমতের প্রতিফলনের সরকার। আপনাদের সঙ্গে দেশের জনগণ রয়েছে, আপনারা সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। কিন্তু খুনি, অর্থপাচারকারী, দাগি অপরাধীরা কিভাবে দেশ থেকে পালাল? আপনারা কেন তাদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছেন?’ তিনি আরো বলেন, সংস্কার করতে যতটুকু সময় লাগে সংস্কারকাজ শেষ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংস্কার কমিশনের জন্য সাত দফা লিখিত প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সব সংস্কারের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয়
সংলাপ শেষে গত রাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাংবাদিকদের বলেন, ‘সব সংস্কারের দায়িত্ব এই সরকারের নয়। বিভিন্ন বিষয় সংস্কারে যে ছয়টি কমিশন করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছি, এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার। সেটা আজ থেকে, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারের এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে হচ্ছে আমরা যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছি, সেই গণ-অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।’
কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত না করতে আমরা আহবান জানিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হত্যার বিচার করতে হবে। তবে আমরা দেখলাম, এসব ট্রাইব্যুনালে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলো। দখলবাজদের পরিবর্তে আরেক দখলবাজ হলো। এসব ঘটনা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা চাই আপনারা একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে যাঁর যাঁর জায়গায় ফিরে যাবেন।’
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের দেশের ধর্মীয় ও আদিবাসী সংখ্যালঘুরা কেন নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে? এটা ঠিক নয়। একটা সম্প্রীতি আবার তৈরি করে আগামী দিনে সংখ্যালঘুদের যেই পূজা উৎসব আছে এবং আদিবাসীদের যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে।’
সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মান : মান্না
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করে গণতন্ত্র মঞ্চের ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা আকবর খান, আবুল হাসান রুবেল, আবু ইউসুফ সেলিম ও ইমরান ইমন।
বিকেল ৪টার দিকে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মান সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে। প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা বলেছি যত দূর পর্যন্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সংস্কার সম্ভব, তত দূর পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে। বাকি যেসব সংস্কার দরকার, তা পরের নির্বাচিত সরকার এসে করবে। মানুষের যদি মনে হয় আপনাদের লিপ্সা আছে, যদি মনে হয় অতীতের মতো ন্যায়-অন্যায় বাছবেন না, অর্থের ধান্দা করবেন, যদি দুর্নীতি বেড়ে যায়, তার দায় আপনাদের ওপর বর্তাবে। আপনারা বলবেন, জানি না, বুঝি না—সেটা হবে না। প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা সমাজের একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত কাজ করি। আমরা মনে করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুরো সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’
সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। এ ব্যাপারে মান্না বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনগেজমেন্ট আরো বেশি এবং নিয়মিত করার কথা বলেছি। দরকার হলে তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের একটা কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। এটা সাপ্তাহিক, পাক্ষিক হতে পারে। এ প্রস্তাবে তাঁরা একমত হয়েছেন।’
সংস্কার প্রসঙ্গে কী কথা হয়েছে—এ প্রশ্নে মান্না বলেন, ‘আমরা বলেছি, আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না, সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি, যাতে নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে। সে কারণে সংস্কার প্রয়োজন। আমরা প্রশাসনের কিছু দুর্বলতা দেখছি, ব্যর্থতা দেখছি, সীমাবদ্ধতা দেখছি। সিভিল পুলিশসহ প্রশাসনে এমন কিছু দেখছি, যা উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো।’
গণতন্ত্র মঞ্চের এই নেতা আরো বলেন, সংস্কারের একটা শর্তই হচ্ছে সবাই সেটা গ্রহণ করবে। ন্যূনতম ঐক্যের প্রচেষ্টা তাদের করতে হবে।
এবি পার্টির ছয় দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা প্রস্তাব
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমার বাংলাদেশ পার্টি তাদের ছয় দফা পর্যবেক্ষণ এবং ১১ দফা প্রস্তাব রাখে। আহ্বায়ক এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলটির প্রতিনিধিদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এবং সহকারী সদস্যসচিব ব্যারিস্টার নাসরীন সুলতানা মিলি।
এবি পার্টির পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে—বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের কাজ বেশ মন্থর ও দুর্বল। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার সহযোগী-প্রতিভূরা বসে আছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকার আইন ও সংবিধান মানার কথা বলছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে আইন-সংবিধান মান্য করার চেয়েও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের দ্বিমুখিতা প্রকাশ পাচ্ছে এবং সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
দলটির প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতার সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও রাজনৈতিক দল ও সব সামাজিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যথা দ্রুত সম্ভব সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
সব মামলা প্রত্যাহার চায় হেফাজত
সংলাপে ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি যত মামলা রয়েছে তার সব কটি দ্রুত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে শিক্ষা সংস্কারের জন্য আলেমদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের দাবি জানায় সংগঠনটি। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ই আছে ৮০টি মামলা। দ্রুত সময়ের মধ্যে সব মামলা প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বায়তুল মোকাররম মসজিদে যোগ্য লোককে নিয়োগের কথা বলেছি। সেই সঙ্গে দুর্গাপূজায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছি।’ হেফাজত নেতাদের মধ্যে সংলাপে অংশ নেন মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ, আহমদ আব্দুল কাদের, মাহফুজুল হক, মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, জোনায়েদ আল হাবিব, আতাউল্লাহ আমিন, মনির হোসাইন কাসেমি, আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রমুখ।
সংলাপ সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম গত রাতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি সমান্তরালভাবে চলবে। সব রাজনৈতিক দল সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।