ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসীমের সীমাহীন দুর্নীতি

২০১৮ সালে নেত্রকোনা-৩ (আটপাড়া ও কেন্দুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন অসীম কুমার উকিল। এর আগে নির্বাচনী এলাকায় তার তেমন পরিচিতি ছিল না। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। নির্বাচনী এলাকায় ‘বহিরাগত’ তকমাও আছে তার নামের সঙ্গে। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগও ছিল কম। ফলে গত ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তবে এমপি থাকার সময় তিনি এলাকায় একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়েছেন। দুর্নীতি, লুটপাট করে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। এসব টাকায় দেশে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল অসীম কুমার উকিলের। এলাকায় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে ওঠার পেছনে এটাই ছিল তার নেপথ্য শক্তি। ক্ষমতার দাপটে এলাকার উন্নয়নের চেয়ে নিজের সম্পদ বাড়াতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

অসীম কুমার উকিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তার স্ত্রী অপু উকিল নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত

নারী সংসদ সদস্য ও আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এলাকায় প্রচার রয়েছে, অপু উকিল নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলোচিত পাপিয়া কা-ের মদদদাতা ছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর পালিয়ে গিয়ে অসীম কুমারকে ভারতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের সস্ত্রীক আড্ডা দিতে দেখা গেছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

এমপি থাকাকালে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন ব্যাংকে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ করেন নেত্রকোনা জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দুদক বরাবর করা অভিযোগ ওই সময় কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।

জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতির অভিযোগে বলা হয়েছিল, অসীম কুমার উকিল দুর্নীতি, লুটপাটের টাকায় ঢাকার উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডে দুই ইউনিটের সাততলা বাড়ির ১৪টি ফ্ল্যাট, ঢাকার ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট, নেত্রকোনার কেন্দুয়া পৌরসভায় সাউদপাড়ায় রাজকীয় বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া নেত্রকোনা সদরের কাটলী মৌজায় মূল্যবান জায়গা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মধ্যে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে রাজউক থেকে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের খড়ম পট্টিতে উকিল নিবাস নামেও একটি বাড়ি রয়েছে। অসীমের ভাই অশেষ কুমারের নামে চট্টগ্রামে শিপিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা ও শপিংমল রয়েছে। অমীম কুমারের দুই ছেলে সায়ক উকিলের নামে কানাডায় ও শুদ্ধ উকিলের নামে লন্ডনে বাড়ি রয়েছে। ভারতের বেঙ্গালুরে তাদের বিশাল বাড়ি রয়েছে বলেও অভিযোগে জানা গেছে।

অসীম কুমারের নির্বাচনী এলাকায় (আটপাড়া ও কেন্দুয়ায়) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি নিজের পছন্দের লোক দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন। এলাকার টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারি কাজ বণ্টন করতেন। এমপি থাকাকালে তিনি এলাকার দৃশ্যমান উন্নয়ন না করলেও নিজের উন্নয়ন ঠিকই করেছেন। বাড়িতে করেছেন অট্টালিকার মতো রাজকীয় এক প্রাসাদ। অভিযোগ আছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদের নৌকা প্রতীক বরাদ্দ ও প্রভাব খাটিয়ে প্রার্থী জয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসীম কুমার উকিল।

অভিযোগ রয়েছে, অসীম কুমার উকিল ও স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন। পাচার করা টাকার খোঁজে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ দম্পতি এবং তাদের সন্তান শায়ক ও শুদ্ধ উকিলের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়েছে। এর আগে এই দম্পতির দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন তৎকালীন নেত্রকোনা জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভাঙচুর ও নাশকতার অভিযোগে অসীম উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে থানায় কমপক্ষে তিনটি মামলা হয়েছে। সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, অসীম কুমার উকিল লুটপাট করে এই আসনের সব এমপির রেকর্ড ভেঙেছেন। তিনি এবং তার স্ত্রী নিয়োগ, দলীয় পদ-পদবি সব কিছুতেই বাণিজ্য করে লুটেরার রাজ্যে পরিণত করেছেন।

কেন্দুয়া থানার ওসি মোহম্মাদ মিজানুর রহমান বলেন, অসীম কুমার উকিলের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা রয়েছে। পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

অসীমের সীমাহীন দুর্নীতি

আপডেট টাইম : ১২ ঘন্টা আগে

২০১৮ সালে নেত্রকোনা-৩ (আটপাড়া ও কেন্দুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন অসীম কুমার উকিল। এর আগে নির্বাচনী এলাকায় তার তেমন পরিচিতি ছিল না। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। নির্বাচনী এলাকায় ‘বহিরাগত’ তকমাও আছে তার নামের সঙ্গে। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগও ছিল কম। ফলে গত ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। তবে এমপি থাকার সময় তিনি এলাকায় একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়েছেন। দুর্নীতি, লুটপাট করে হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। এসব টাকায় দেশে বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল অসীম কুমার উকিলের। এলাকায় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে ওঠার পেছনে এটাই ছিল তার নেপথ্য শক্তি। ক্ষমতার দাপটে এলাকার উন্নয়নের চেয়ে নিজের সম্পদ বাড়াতে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

অসীম কুমার উকিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তার স্ত্রী অপু উকিল নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত

নারী সংসদ সদস্য ও আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এলাকায় প্রচার রয়েছে, অপু উকিল নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলোচিত পাপিয়া কা-ের মদদদাতা ছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর পালিয়ে গিয়ে অসীম কুমারকে ভারতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের সস্ত্রীক আড্ডা দিতে দেখা গেছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

এমপি থাকাকালে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর অসীম কুমার উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিভিন্ন ব্যাংকে অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ করেন নেত্রকোনা জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দুদক বরাবর করা অভিযোগ ওই সময় কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।

জেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতির অভিযোগে বলা হয়েছিল, অসীম কুমার উকিল দুর্নীতি, লুটপাটের টাকায় ঢাকার উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডে দুই ইউনিটের সাততলা বাড়ির ১৪টি ফ্ল্যাট, ঢাকার ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট, নেত্রকোনার কেন্দুয়া পৌরসভায় সাউদপাড়ায় রাজকীয় বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এ ছাড়া নেত্রকোনা সদরের কাটলী মৌজায় মূল্যবান জায়গা, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মধ্যে বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। ঢাকার পূর্বাচলে রাজউক থেকে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের খড়ম পট্টিতে উকিল নিবাস নামেও একটি বাড়ি রয়েছে। অসীমের ভাই অশেষ কুমারের নামে চট্টগ্রামে শিপিং লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা ও শপিংমল রয়েছে। অমীম কুমারের দুই ছেলে সায়ক উকিলের নামে কানাডায় ও শুদ্ধ উকিলের নামে লন্ডনে বাড়ি রয়েছে। ভারতের বেঙ্গালুরে তাদের বিশাল বাড়ি রয়েছে বলেও অভিযোগে জানা গেছে।

অসীম কুমারের নির্বাচনী এলাকায় (আটপাড়া ও কেন্দুয়ায়) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি নিজের পছন্দের লোক দিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন। এলাকার টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারি কাজ বণ্টন করতেন। এমপি থাকাকালে তিনি এলাকার দৃশ্যমান উন্নয়ন না করলেও নিজের উন্নয়ন ঠিকই করেছেন। বাড়িতে করেছেন অট্টালিকার মতো রাজকীয় এক প্রাসাদ। অভিযোগ আছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদের নৌকা প্রতীক বরাদ্দ ও প্রভাব খাটিয়ে প্রার্থী জয়ের জন্য কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসীম কুমার উকিল।

অভিযোগ রয়েছে, অসীম কুমার উকিল ও স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন। পাচার করা টাকার খোঁজে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ দম্পতি এবং তাদের সন্তান শায়ক ও শুদ্ধ উকিলের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়েছে। এর আগে এই দম্পতির দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন তৎকালীন নেত্রকোনা জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভাঙচুর ও নাশকতার অভিযোগে অসীম উকিল ও তার স্ত্রী অপু উকিলের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে থানায় কমপক্ষে তিনটি মামলা হয়েছে। সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, অসীম কুমার উকিল লুটপাট করে এই আসনের সব এমপির রেকর্ড ভেঙেছেন। তিনি এবং তার স্ত্রী নিয়োগ, দলীয় পদ-পদবি সব কিছুতেই বাণিজ্য করে লুটেরার রাজ্যে পরিণত করেছেন।

কেন্দুয়া থানার ওসি মোহম্মাদ মিজানুর রহমান বলেন, অসীম কুমার উকিলের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা রয়েছে। পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।