মানবদেহের জোড়াগুলোর মধ্যে কাঁধের জোড়ায় সবচেয়ে বেশি নড়াচড়া হয় এবং গঠনগতভাবে অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে কম দৃঢ় অবস্থায় থাকে। ফলে স্বাভাবিক আঘাত ছাড়াও নানা রোগের কারণে কাঁধ ইনজুরিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। জীবনের কোনো না সময় প্রতি পাঁচজনের একজন কাঁধের ইনজুরিতে ভোগে। কাঁধে তৎক্ষণাৎ ও দীর্ঘমেয়াদি ইনজুরি হয়। কাঁধে সরাসরি আঘাত এবং কাঁধ, কনুই হাতে ভর করে পড়ে গেলে কাঁধের তৎক্ষণাৎ ইনজুরি হয়।
কোনো কিছুতে ঘুষি দিয়েছেন বা ঘুষি মিস হয়েছে এতে কাঁধের ইনজুরি হতে পারে। পেশাগত কারণে পুনরাবৃত্তি কাজ যেমন পেইন্টিং, গ্লাস পরিষ্কার করা, ওজন তোলা, বোর্ড লেখা এবং কিছু ধরনের খেলাধুলা কাঁধের দীর্ঘমেয়াদি ইনজুরি করে থাকে। এ ছাড়া বয়স্কদের ব্যবহারজনিত ক্ষয়, জোড়ায় অতিরিক্ত হাড় (আর্থাইটিস) এবং কিছু কিছু রোগ কাঁধের দীর্ঘমেয়াদি ইনজুরি করে এবং রোগকে তরান্বিত করে। যেভাবেই ইনজুরি হোক না কেন তীব্রতার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন স্তরে জোড়ার ক্ষতি হতে পারে। কলার বোন ভাঙতে পারে এবং এর দুপ্রান্তের দুটো জোড়া মচকাতে বা স্থানচ্যুতি হতে পারে। কাঁধের জোড়ার আবরণ (ক্যাপসুল), লিগামেন্ট, মাংসপেশি আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিঁড়তে পারে, জোড়ার হাড় ভাঙতে পারে এবং জোড়া আংশিক বা সম্পূর্ণ ডিসপ্লেসমেন্ট হতে পারে।
পিঠের হাড় স্ক্যাপুলা ও এর পেশির ইনজুরি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তৎক্ষণাৎ ইনজুরিতে তীব্র ব্যথা হয়, জোড়া ফুলে যায়, কাঁধ নড়াচড়া করা যায় না, হাড় ও জোড়ার অস্বাভাবিক আকৃতি ও অবস্থান এবং স্নায়ু ও রক্তনালির সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি ইনজুরির ক্ষেত্রে কাঁধে ব্যথা হয়, নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়, কাঁধে কাত হয়ে ঘুমানো যায় না, ব্যথা ও সীমিত নড়াচড়ার জন্য পিঠ চুলকানো, জামার বোতাম লাগানো এবং মাথার চুল আঁচড়ানো কষ্টকর। পেশি শুকিয়ে যাওয়ার জন্য কাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হাত দিয়ে কিছু তোলা যায় না। ক্যাপসুল (জোড়ার আবরণ) ও লিগামেন্ট ইনজুরির কারণে জোড়া বারবার ছুটে যায় বা ছুটে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কখনও কখনও প্রথম ডিসপ্লেসমেন্টের পরবর্তী পরিচর্যা (রিহেবিলিটেশন) ঠিকমতো না হলে জোড়া বার বার ছুটে যাওয়ার প্রবণতা হয়। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে জোড়ার হাড় ও তরুণাস্থি’ ক্ষয় হয়, আবরণ পাতলা হয় এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে জয়েন্ট নষ্ট হয়।
প্রাথমিক করণীয় : তৎক্ষণাৎ ইনজুরি হলে জোড়াকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। ফলে টিস্যু ইনজুরি ও ব্যথা কম হয়। বরফের টুকরা টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠা-া পানি প্লাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে আসবে। প্রতি ঘণ্টায় ১০ মিনিট বা দুই ঘণ্টা পর পর ২০ মিনিট অনবরত লাগাতে হবে। তবে এটা সহ্যের মধ্যে রাখতে হবে। এই পদ্ধতি আঘাতের ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলবে। জোড়ায় ইলাস্টো কমপ্রেসন বা স্প্ল্লিন্ট ব্যবহারে ফুলা ও ব্যথা কমে আসে। জোড়ায় আর্ম সিলিং বা স্প্লিন্ট দিয়ে উঁচু করে রাখলে ফুলা কম হবে। এনালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন। ব্যথা ও ফুলা সেরে ওঠার পর জোড়া নমনীয় ও পেশি শক্তিশালী হওয়ার ব্যায়াম করতে হবে। হাড় ভাঙলে বা জোড়া স্থানচ্যুতি হলে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
চিকিৎসা : অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। প্রাথমিক নিরাময়ে রোগীর ব্যথা ও ফুলা সেরে ওঠার পর এবং দীর্ঘমেয়াদি ইনজুরির ক্ষেত্রে রোগের ইতিহাস শুনে এবং জোড়ার বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে কী কী ইনজুরি হয়েছে এবং এর তীব্রতা নির্ণয় করতে হবে। কখনো কখনো এক্স-রে ও এমআরআই’র সাহায্য নিতে হয়। প্রয়োজন হলে লিগামেন্ট, জোড়ার আবরণ ও পেশি ইনজুরি, জোড়ার ডিসপ্লেসমেন্ট, আর্থ্রাইটিস ও জোড়ায় অতিরিক্ত হাড় চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম এমন আর্থ্রোস্কোপিক চিকিৎসকের কাছে বা সেন্টারে রোগীকে পাঠাতে হবে। আর্থ্রোস্কোপ ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে কাঁধে প্রবেশ করিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সম্পন্ন করা। হাড় ও তরুণাস্থি’ ক্ষয় এবং অসটিওআর্থ্রাইটিস হয়ে জয়েন্ট নষ্ট হলে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট করতে হবে। প্রাথমিক বা শল্য চিকিৎসার পর নিয়মিত ও উপযুক্ত পরিচর্যা করে জোড়ার স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে।