ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বয়স্কভাতা না দিলেও ভোট নৌকাতেই দিমু

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শরীরডা খারাপ লাগে অহন। বুড়া হইছি তো। একটু হাঁটলেই দম লাইগ্যা আiহে। তবু আর কী করা! ভোট তো আর নষ্ট করন যায়না। তাই ছুইট্যা যাই। নৌকায় ভোট দেই। জীবনের শেষ ভোটটাও নৌকাতেই দিমু। বয়স্কভাতা পাই আর না পাই’-কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার তৈয়বন্নেসা।

৭৫ বছরের এ বৃদ্ধা নিজ চোখে দেখেছেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সে সময়কার স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।

বললেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি জোয়ান আছিলাম। যারে কয় একবারে টগবগা। নিজের চোখে যুদ্ধ দেখছি। আমার স্বামীও যুদ্ধে গেছিল। তহন হ্যায় ব্যাডা আমাগো কথা না ভাইব্যাই দ্যাশের জন্য ঝাঁপায়ে পড়ছিল। অথচ হ্যায় কোনো ভাতাভুতো পায় নাই। ক্যান পাই নাই, সেইটাও কইবার পারিনা।’

যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তৈয়বন্নেসাকে আপ্লুত করে। ঘুমের ঘরে এখনো সেই দিনগুলো তিনি দিব্যি দেখতে পান। বাঙালী কণ্ঠর সঙ্গে শেয়ার করলেন তেমনই এক দিনের কথা।

বললেন, ‘বড় ছেলের বয়স তখন দুই বছর। আমি ভাত বসাইছিলাম চুলায়। হঠাৎ শুনি মিলিটারি খানেরা আসতাছে। আমি রান্না ফালায়ে রাইখ্যা কোলের বাচ্চাটারে নিয়া ছুট মারি।’

যুদ্ধের পর আর গ্রামে থাকেননি তিনি। এতটুকু ভালো থাকার আশায় চলে আসেন রাজধানীতে। ভেবেছিলেন ‘ভাগ্য’ বদলে যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। বরং ১৫/১৬ বছর হলো স্বামীকে হারিয়েছেন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তবুও দমে যাননি তিনি। সংগ্রাম করেছেন। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন।

বর্তমানে উত্তরার নয় নম্বর সেক্টরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বস্তিতে থাকেন তৈয়বন্নেসা। সেখানে থাকে তার ভ্যানগাড়ি চালক ছেলে; যার রোজগারে কোনোমতে চলে তাদের ‘দিন আনা দিন খাওয়া’র সংসার।

ছলছল চোখে তিনি এ প্রতিবেদককে বললেন, ‘বাজান, ভ্যান চালাইয়া আমার পোলাডা আর ক’টাকাইবা পায়। আমাগো দিন খাইয়্যা না খাইয়্যাই যায়। কাপড় টাঙ্গাইয়া এইহানে থাহি। এই এক্কান মোডে ঘর। সবার থাকতে বড্ড কষ্ট হয়। তবুও কী আর করা! থাহন লাগে। না থাইক্যায়বা উপায় কী। সরকার তো আর আমাগো দিকে তাকাইবো না। নেতারা কি গরিবদের দ্যাখে! তারা তো আমাগো হক মাইর্যায় বিল্ডিং করে।’

সরকার কিংবা নেতারা না হয় আপনাদের পাশে দাঁড়ায় না, তাই বলে কি এনজিও-সংগঠনরাও আসেনা আপনাদের চোখের জল মুছে দিতে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুঃখের কথা কী আর কমু বাপু! আসছিলো একবার। লিইখ্যাও নিয়া গেছিলো নামধাম। পরে আর খোঁজ নেই। মনে হয়, নেতাকর্মীরাই সেসব সাহায্যের টাকা-পয়সা মাইরা দিছে। আমাগো হাত পর্যন্ত আইস্যা পৌঁছায়নি আর। সবই কপাল, বুঝলেন।’

জীবনের ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও তৈয়বন্নেসার কপালে জোটেনি বয়স্কাভাতা। অবশ্য এ নিয়ে অভিযোগও নেই তার। বরং বললেন, ‘আল্লাহ শেখের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বেডিরে ভালা রাখুক। হে ভালা মানুষ। গরিবগোরে ভালোবাসে। সমস্যা হইলো গিয়া আশেপাশের নেতারা। তারাই সব টাকা-পয়সা মাইর্যাধ খায়।’

মাঝেমধ্যে বিমর্ষ হয়ে পড়েন তৈয়বন্নেসা। মন খারাপ করে একলা বসে থাকেন। চোখের জল ফেলেন। ঠিক যেমন ফেলেছিলেন এবারের ঈদে।

বললেন, ‘ঈদ এলেই মতি মিয়ার (তার স্বামী) কথা মনে পইড়্যা যায়। বড্ড ভালোবাসতো আমারে লোকটা। সাধ্যমতো চেষ্টা করতো আমারে খুশি করতে। সবাইরে ভালো রাখতে। নতুন জামা-কাপড় দিতে। তারে বলা লাগতো না, সে এমনিতেই সেমাই-গোস্ত নিয়া আইতো।’

এবারের ঈদে মাংস খেতে পেরেছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি চোখ মুছে বলেন, ‘লোকের বাসা থেইক্যা দুই-তিন টুকরা করে কুড়াইয়া অল্প কিছু গোস্ত পাইছিলাম, যেগুলান একবার রাইন্ধাই শ্যাষ। এরপরে খাওনের আর কিছু নাই।’

এলাকার প্রভাবশালীরাও তার মতো অসহায়দের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না বলেও জানালেন তিনি।বললেন, ‘আমাগো কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করে না। কাপড়-চোপড়-ট্যাকা-পয়সা দেয় না। উফরে, আবার কয়দিন পরপর এই জায়গা থেইক্যা উঠাইয়া দেয়, ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দেয়। আপনেই কন, ঘর ভাইঙ্গা দিলে এই বয়সে যাইয়া আমি কই থাকমু। ঘর ভাড়া দিয়া থাহার ট্যাকা কি আমার আছে!’

বয়সের ভারে হাঁটাচলা করতে পারেন না এ বৃদ্ধা। শুয়ে-বসে সময় কাটলেও স্বপ্ন দেখেন, বুকে আশা বাঁধেন। মৃত্যুর আগে একবার হলেও বয়স্কভাতা পাবেন, নিজের টাকায় মাংস রেঁধে পেটপুরে খাবেন। নাতি-নাতনি, স্বজনদের খাওয়াবেন। তাদের বায়না রাখবেন।

এখন সবটাই নির্ভর করছে সরকারের ওপর। তাদের একটু সুদৃষ্টিই পারে, তৈয়বন্নেসার মুখে হাসি ফোটাতে। শেষ যাত্রার আগে, শেষ ইচ্ছেটি পূরণের।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

বয়স্কভাতা না দিলেও ভোট নৌকাতেই দিমু

আপডেট টাইম : ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শরীরডা খারাপ লাগে অহন। বুড়া হইছি তো। একটু হাঁটলেই দম লাইগ্যা আiহে। তবু আর কী করা! ভোট তো আর নষ্ট করন যায়না। তাই ছুইট্যা যাই। নৌকায় ভোট দেই। জীবনের শেষ ভোটটাও নৌকাতেই দিমু। বয়স্কভাতা পাই আর না পাই’-কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার তৈয়বন্নেসা।

৭৫ বছরের এ বৃদ্ধা নিজ চোখে দেখেছেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সে সময়কার স্মৃতিচারণ করলেন তিনি।

বললেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি জোয়ান আছিলাম। যারে কয় একবারে টগবগা। নিজের চোখে যুদ্ধ দেখছি। আমার স্বামীও যুদ্ধে গেছিল। তহন হ্যায় ব্যাডা আমাগো কথা না ভাইব্যাই দ্যাশের জন্য ঝাঁপায়ে পড়ছিল। অথচ হ্যায় কোনো ভাতাভুতো পায় নাই। ক্যান পাই নাই, সেইটাও কইবার পারিনা।’

যুদ্ধের স্মৃতি এখনো তৈয়বন্নেসাকে আপ্লুত করে। ঘুমের ঘরে এখনো সেই দিনগুলো তিনি দিব্যি দেখতে পান। বাঙালী কণ্ঠর সঙ্গে শেয়ার করলেন তেমনই এক দিনের কথা।

বললেন, ‘বড় ছেলের বয়স তখন দুই বছর। আমি ভাত বসাইছিলাম চুলায়। হঠাৎ শুনি মিলিটারি খানেরা আসতাছে। আমি রান্না ফালায়ে রাইখ্যা কোলের বাচ্চাটারে নিয়া ছুট মারি।’

যুদ্ধের পর আর গ্রামে থাকেননি তিনি। এতটুকু ভালো থাকার আশায় চলে আসেন রাজধানীতে। ভেবেছিলেন ‘ভাগ্য’ বদলে যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। বরং ১৫/১৬ বছর হলো স্বামীকে হারিয়েছেন। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তবুও দমে যাননি তিনি। সংগ্রাম করেছেন। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন।

বর্তমানে উত্তরার নয় নম্বর সেক্টরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বস্তিতে থাকেন তৈয়বন্নেসা। সেখানে থাকে তার ভ্যানগাড়ি চালক ছেলে; যার রোজগারে কোনোমতে চলে তাদের ‘দিন আনা দিন খাওয়া’র সংসার।

ছলছল চোখে তিনি এ প্রতিবেদককে বললেন, ‘বাজান, ভ্যান চালাইয়া আমার পোলাডা আর ক’টাকাইবা পায়। আমাগো দিন খাইয়্যা না খাইয়্যাই যায়। কাপড় টাঙ্গাইয়া এইহানে থাহি। এই এক্কান মোডে ঘর। সবার থাকতে বড্ড কষ্ট হয়। তবুও কী আর করা! থাহন লাগে। না থাইক্যায়বা উপায় কী। সরকার তো আর আমাগো দিকে তাকাইবো না। নেতারা কি গরিবদের দ্যাখে! তারা তো আমাগো হক মাইর্যায় বিল্ডিং করে।’

সরকার কিংবা নেতারা না হয় আপনাদের পাশে দাঁড়ায় না, তাই বলে কি এনজিও-সংগঠনরাও আসেনা আপনাদের চোখের জল মুছে দিতে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুঃখের কথা কী আর কমু বাপু! আসছিলো একবার। লিইখ্যাও নিয়া গেছিলো নামধাম। পরে আর খোঁজ নেই। মনে হয়, নেতাকর্মীরাই সেসব সাহায্যের টাকা-পয়সা মাইরা দিছে। আমাগো হাত পর্যন্ত আইস্যা পৌঁছায়নি আর। সবই কপাল, বুঝলেন।’

জীবনের ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলেও তৈয়বন্নেসার কপালে জোটেনি বয়স্কাভাতা। অবশ্য এ নিয়ে অভিযোগও নেই তার। বরং বললেন, ‘আল্লাহ শেখের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বেডিরে ভালা রাখুক। হে ভালা মানুষ। গরিবগোরে ভালোবাসে। সমস্যা হইলো গিয়া আশেপাশের নেতারা। তারাই সব টাকা-পয়সা মাইর্যাধ খায়।’

মাঝেমধ্যে বিমর্ষ হয়ে পড়েন তৈয়বন্নেসা। মন খারাপ করে একলা বসে থাকেন। চোখের জল ফেলেন। ঠিক যেমন ফেলেছিলেন এবারের ঈদে।

বললেন, ‘ঈদ এলেই মতি মিয়ার (তার স্বামী) কথা মনে পইড়্যা যায়। বড্ড ভালোবাসতো আমারে লোকটা। সাধ্যমতো চেষ্টা করতো আমারে খুশি করতে। সবাইরে ভালো রাখতে। নতুন জামা-কাপড় দিতে। তারে বলা লাগতো না, সে এমনিতেই সেমাই-গোস্ত নিয়া আইতো।’

এবারের ঈদে মাংস খেতে পেরেছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি চোখ মুছে বলেন, ‘লোকের বাসা থেইক্যা দুই-তিন টুকরা করে কুড়াইয়া অল্প কিছু গোস্ত পাইছিলাম, যেগুলান একবার রাইন্ধাই শ্যাষ। এরপরে খাওনের আর কিছু নাই।’

এলাকার প্রভাবশালীরাও তার মতো অসহায়দের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না বলেও জানালেন তিনি।বললেন, ‘আমাগো কেউ কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করে না। কাপড়-চোপড়-ট্যাকা-পয়সা দেয় না। উফরে, আবার কয়দিন পরপর এই জায়গা থেইক্যা উঠাইয়া দেয়, ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দেয়। আপনেই কন, ঘর ভাইঙ্গা দিলে এই বয়সে যাইয়া আমি কই থাকমু। ঘর ভাড়া দিয়া থাহার ট্যাকা কি আমার আছে!’

বয়সের ভারে হাঁটাচলা করতে পারেন না এ বৃদ্ধা। শুয়ে-বসে সময় কাটলেও স্বপ্ন দেখেন, বুকে আশা বাঁধেন। মৃত্যুর আগে একবার হলেও বয়স্কভাতা পাবেন, নিজের টাকায় মাংস রেঁধে পেটপুরে খাবেন। নাতি-নাতনি, স্বজনদের খাওয়াবেন। তাদের বায়না রাখবেন।

এখন সবটাই নির্ভর করছে সরকারের ওপর। তাদের একটু সুদৃষ্টিই পারে, তৈয়বন্নেসার মুখে হাসি ফোটাতে। শেষ যাত্রার আগে, শেষ ইচ্ছেটি পূরণের।