বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ গ্রামের গাছে গাছে মাটির কলস। দেখলে যে কেউ কৌতূহলী হবেন। তবে একটু খেয়াল করলেই কৌতূহল মিটবে। কোনোটায় পাখি ঢুকছে আবার কোনোটা থেকে ফুড়ুত করে উড়ে যাচ্ছে। দিন শেষে একেকটি মাটির কলস হয়ে উঠছে পাখির নিরাপদ আশ্রয়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামে দেখা মিলবে ব্যতিক্রমী এই দৃশ্যের। গ্রামের গাছে গাছে ঝুলছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাটির কলস। পাখির জন্য ভালোবাসার এমন উদ্যোগ গ্রামের তরুণ আহম্মদ উল্লাহর। গাছে গাছে কলস বেঁধে পাখির বাসা তৈরি করাই তার শখ। ২০০১ সাল থেকে করছেন কাজটি। শুরুটা শখ করে হলেও এখন কাজটি যেন তার নেশায় রূপ নিয়েছে। ২০০৭ সালে ‘ন্যাচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট প্রিজারভেশন অর্গানাইজেশন (নিপো)’ নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এই তরুণ।
সংগঠনের তরুণ সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে প্রশংসনীয় যে কাজগুলো করেছেন সেগুলো হলো— দুইটি বিরল প্রজাতির আহত হুতুম ছানাকে সুস্থ করে তোলা, ঝড়ের মধ্যে মাটিতে পড়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির চিল ছানাকে ছোট থেকে বড় করে অবমুক্ত করা, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কুইজ প্রতিযোগিতা, ধানের জমিতে পাখির দ্বারা পোকামাকড় দমনে কঞ্চি পোঁতা অভিযান, অসুস্থ ও বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখিদের রক্ষা করে অবমুক্ত করা, বিরল প্রজাতির শকুন উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের নিকট হস্তান্তর।
আহম্মদ উল্লাহ জানান, শখ করে পাখি সংরক্ষণ শুরু করেছিলাম, এখন তা নেশা হয়ে গেছে। প্রথমে মানুষ আমাকে পাগল বলত। এখন সবাই সহযোগিতা করে। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম জেলাব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই। এ পর্যন্ত গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গাছে মাটির হাঁড়ি, কলস স্থাপন করে প্রায় ৫ হাজার পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে বলে আহম্মদ উল্লাহ জানান।
পাখির প্রতি অনন্য ভালোবাসা থেকে এই তরুণ নিজের সীমিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজ গ্রামে পাখিদের বাসা তৈরি করার মাধ্যমেই সূচনা করেন তার পাখি সংরক্ষণ কর্মসূচি। আহম্মদ উল্লাহর শুধু একটিই চাওয়া, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এবং বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় পাখিদের সংরক্ষণের কাজে সকলে এগিয়ে আসবেন।
এদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নিরাপদ বাসা তৈরি করে পাখির প্রতি এমন ভালবাসা দেখিয়েছেন নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘সেতুবন্ধন’। দেশীয় পাখি সংরক্ষণ পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে- এমন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ব্যতিক্রমী এ কাজে নিবেদিত হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে সূচনা করেন তার পাখি সংরক্ষণ কর্মসূচি।
ওই এলাকার বটগাছ, আমগাছ, কাঁঠালগাছসহ নানা জাতের গাছে বেঁধে রাখা হয়েছে অসংখ্য কলস। দুইটি ডালের মাঝখানে কায়দা করে এমনভাবে হাঁড়িগুলো বসানো হয়েছে যেন বৃষ্টির পানি ভিতরে যেতে না পারে, আবার ঝড়-ঝঞ্ঝায় ছিটেফোঁটা পানি ঢুকে গেলেও যাতে পানি জমে না যায় তা নিশ্চিত করতে কলসগুলোতে ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে। আর তাই কালবৈশাখীসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাশ্রয়ী পাখিদের অনেকেই দল বেঁধে ছুটে আসছে এই আবাসনে।
বর্তমানে সৈয়দপুর উপজেলায় ছয় হাজার গাছে কলস বেঁধে দিতে পেরেছেন বলে জানান আলমগীর হোসেন। যেখানে নিশ্চিন্তে আবাস গড়ে তুলেছে নানা প্রজাতির দেশীয় পাখি। আলমগীর হোসেন জানান, পাখিরা না থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে না। তাছাড়া কৃষিতে পাখিদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে চাষাবাদে ভূমিকা রাখছে। সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম এখন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। পরিচিত বিভিন্ন পাখি ছাড়াও বেশ কিছু অপরিচিত পাখিও এখন এ অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। গাছে ঝোলানো মাটির পাত্রের ভেতর থেকে বের হয় শালিক, দোয়েলসহ নানা জাতের দেশীয় পাখি। কোনো কোনো পাত্রের ভেতর ছোট বাচ্চার চি-চি আওয়াজও শোনা যায়। চারপাশেই পাখিদের কিচির মিচির শব্দ।
প্রাকৃতিক এমন এক নৈসর্গিক পরিবেশ বিরাজ করছে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার কৈট্টা প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রেও। পাখিপ্রেমি তরুণ কামরুল ইসলাম দেশীয় পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান গড়ে দিতে নিজ খরচে মাটির পাত্র তৈরি করে গাছের ডালে ঝুলিয়েছেন। প্রশিকা ছাড়াও তার এই মাটির পাত্রের পাখির বাসা ঝুলানো হয়েছে মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপারের বাসভবন, সাটুরিয়া থানা ও সিংগাইরসহ বিভিন্ন এলাকায়। যেখানে নিশ্চিন্তে আবাস গড়ে বংশ বিস্তার করছে হরেক রকম পাখি।
কামরুল ইসলাম জানান, ঝড়-বৃষ্টিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাখির বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে ডিম এবং বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বংশবিস্তার কমে যাওয়ায় দেশীয় পাখির সংখ্যা দিন দিন কমছে।
এই তরুণ আরো জানান, ইন্টারনেট থেকে কোন ধরনের পাখি কি ধরনের বাসা পছন্দ করে তার একটা ধারণা নেই। কুমার বাড়ি থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ১শ মাটির পাত্র তৈরি করি। পাখি ভেদে পাত্রের আকার ও আকৃতি আলাদা। বৃষ্টির পানি যেন জমে না থাকে সেজন্য প্রতিটি পাত্রেই ছিদ্র করা হয়। সেগুলো প্রশিকায় ঝোলানো হয়। প্রথমে আমিও শঙ্কিত ছিলাম এই বাসায় পাখি আসবে কিনা;কিন্তু দেখা গেল পাত্র দখলের জন্য প্রতিদিন পাখিতে পাখিতে রীতিমতো ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আরো ৫ শতাধিক মাটির পাত্র তৈরি করে যেখানে গাছপালা বেশি সেখানে ঝুলানো হয়েছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পাখি। সম্প্রতি কয়েক দফা ঝড়-বৃষ্টিতে বাসা ভেঙে বা নষ্ট হয়ে আশ্রয়হীন হয়েছে অনেক পাখি। আর এভাবেই বিলুপ্তির পথে চলন বিলাঞ্চলের হরেক জাতের পাখি। তাই পাখির প্রতি অনন্য ভালোবাসায় গাছে গাছে হঁড়ি বেঁধে পাখিদের ঘর-সংসার গড়ে তুলেছেন পরিবেশ বাদী সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সদস্যরা।