ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আঁধার চিরে আলোর পথে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ হিন্দ ইবনে উতবা (রা.) এর কাছেও ইসলামের সত্যতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি কয়েকজন সত্যান্বেষী মহিলার সঙ্গে বোরকা আবৃত হয়ে হাজির হলেন দরবারে রেসালতে। আঁধার চিরে এলেন আলোর পথে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অমায়িক মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম কবুল করেন হিন্দ

নিশ্চয় মানুষের অন্তরের অবস্থান মহান আল্লাহর কুদরতি হাতের দুই আঙুলের মাঝে। আল্লাহ তায়ালা যাকে যখন যেমন চান, তেমন করে থাকেন। হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) ইসলামের ইতিহাসের খুবই আকর্ষণীয় এক নারী চরিত্র। যিনি জীবনের এক পর্বে বাবা ও স্বামীর সঙ্গে সমানে ইসলামদ্রোহিতা চালিয়ে গেছেন। ইসলাম, মুসলমান ও নবী (সা.) এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছরেরও অধিক সময় চরম শত্রুতা করে গেছেন। জানমাল বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামবিদ্বেষের তরে। আরেক পর্বে এসে সর্বোতভাবে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন ইসলামের সেবায়। ফতহে মক্কার পর থেকে সম্পূর্ণ পাল্টে যান তিনি। আবির্র্ভূত হন ইসলামের নিষ্ঠাবতী সেবকরূপে।

কোনো সন্দেহ নেই, হজরত হিন্দ (রা.) ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী ও বুদ্ধিমতী। বক্তব্যে ছিলেন স্পষ্ট ও অকপট। তার বংশলতিকা হচ্ছেÑ হিন্দ বিনতে উতবা বিনতে রাবিয়া ইবনে আবদু মান্নাফ ইবনে আবদু শামস আল আবশামিয়া আল কারশিয়া। (তারিখে দিমাশক : ৪৩৭)। তিনি ইসলামের আগে ও পরে আরবের একজন বিশিষ্ট মহীয়সী নারী হিসেবে বিবেচিত এবং উমাইয়া খলিফা হজরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) এর আম্মাজান। রূপ, সৌন্দর্য, মতামত, সিদ্ধান্ত, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, ভাষার শুদ্ধতা ও অলংকার, সাহিত্য, কবিতা, বীরত্ব-সাহসিকতা ও আত্মসম্মানবোধের অধিকারিণী ছিলেন হিন্দ বিনতে উতবা। ইমাম যাহাবি বলেন, ‘হিন্দ ছিলেন কোরাইশ নারীদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুন্দরী ও জ্ঞানী।’ (তারিখুল ইসলাম : ৩/২৯৮)।
বিশ্ববাসীকে অন্ধকারের গভীর অমানিশা থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে এক সময় মক্কায় ইসলামের অভ্যুদয় হলো। পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত হিন্দ ইসলামের আহ্বানের প্রতি কর্ণপাত করেননি; বরং তার এ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে আল্লাহর রাসুল, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতায়। এ সময় শত্রুতা প্রকাশের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেননি তিনি। বদরযুদ্ধের সূচনাতেই হিন্দের বাবা, ভাই ও চাচা নিহত হয়। শুধু তাই নয়, পৌত্তলিক বাহিনীর ৭০ জন বাছা বাছা সৈনিকও নিহত হয়।
এ বিজয়ে মুসলমানরা যেমন দারুণ উৎফুল্ল হন তেমনই কোরাইশ বাহিনীর খবর মক্কায় পৌঁছলে সেখানের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই হয়ে যায় হতবাক। প্রথমে অনেকে সে খবর বিশ্বাস করতে পারেনি। পরাজিতরা যখন মক্কায় ফিরতে লাগল তখন খবরের যথার্থতা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ অবশিষ্ট রইল না। ঘটনার ভয়াবহতায় মক্কাবাসীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হিন্দ তেল-সুগন্ধির ধারে-কাছেও গেলেন না এবং আবু সুফিয়ানের শয্যা থেকেও দূরে থাকলেন। পরবর্তী ওহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত মক্কাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর বদরে নিহতদের স্মরণে রচনা করলেন প্রচুর শোকগাথা। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কোরাইশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ওহুদ যুদ্ধের দামামা সন্নিকটে। তারা তাদের সব সৈন্যসামন্ত এবং সহযোগী গোত্র-গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধের জন্য এগোতে থাকে। কোরাইশ নেতারা তাদের প্রতিশোধের অভীষ্ট লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করে মাত্র দুইজন মানুষকে। তাদের একজন হচ্ছেন রাসুলুল্লাহ (সা.) আর অপরজন হচ্ছেন হজরত হামজা (রা.)।
কোরাইশরা রওনা হওয়ার আগে একজন লোক মনোনীত করল, যাকে হজরত হামজা (রা.) কে শেষ পরিণতিতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এই লোক ছিল একজন হাবশি। তীরবাজিতে ছিল সে খুব দক্ষ। কোরাইশরা তাকে শুধু এ দায়িত্ব দিয়েছে যে, সে যেন হামজাকে শিকার করে। তাকে তীরবিদ্ধ করে যাতে জীবনাবসান ঘটানো হয়। কোরাইশরা তাকে এ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনো দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেনি। যুদ্ধ যেদিকেই গড়াক, যে করেই হোক তুমি তাকে তীরবিদ্ধ করে মেরে ফেলতে ভুলবে না।
কোরাইশরা তাকে বহু বড় বড় পুরস্কারের লোভ দেখায়। তাকে মুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস দেয়। এই হাবশি লোকটির নাম ‘ওয়াহশি’। এরপর কোরাইশরা ওয়াহশিকে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবার কাছে সোপর্দ করে দেয়, যাতে সে তাকে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মনোবল বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। কোরাইশরা লড়াইয়ে বের হওয়ার কয়েক দিন আগ থেকে হিন্দ তার পূর্ণ ক্ষোভ, দুঃখ, হিংসা আর প্রতিশোধস্পৃহা ওয়াহশির মনে গভীরভাবে গেঁথে দেয়। হামজাকে খুন করার বিনিময়ে বিরাট বিরাট লোভনীয় পুরস্কারের অঙ্গীকার করা হয়। তাকে খুব মূল্যবান স্বর্ণ, রুপা ও মুক্তার অলংকার পুরস্কার দেয়ার লোভ দেখানো হয়। হিন্দ নিজের গলার হার, হাতের চুড়িসহ সব অলংকার ওয়াহশির সামনে বের করে দেয়। বলেÑ এসব কিছুই তুমি পাবে; তুমি শুধু এর বিনিময়ে আমাকে হামজার মস্তক উপহার দেবে।
দুনিয়ার সবচেয়ে দামি দামি অলংকারের মোহে পড়ে যায় ওয়াহশি। সে যুদ্ধের প্রহর গুনতে থাকে, আর তীর নিক্ষেপের অনুশীলন করতে থাকে। হামজাকে খুন করার কাজে কৃতকার্য হতে পারলে সে আজাদ হতে পারবে। এর বিনিময়ে কোরাইশের এক নেতা, নেতার স্ত্রী ও নেতার মেয়ের গলায় পরা দামি অলংকারও তার হাতে আসবে।
শেষে একদিন ওহুদ যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধেও হামজা (রা.) এর বীরত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। প্রতিপক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তিনি সিংহবিক্রমে লড়াই করছিলেন। তিনি দুই হাতে এমনভাবে তরবারি পরিচালনা করছিলেন যে, শত্রুপক্ষের কেউ তার সামনে টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এদিকে মক্কার নেতা যুবাইর ইবনে মুতইমের হাবশি গোলাম ওয়াহশি ইবনে হারব একটি ছোট বর্শা হাতে নিয়ে আড়ালে ওতপেতে বসেছিল হামজা (রা.) কে নাগালে পাওয়ার জন্য। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিবা ইবনে আবদুল ওজ্জা হামজার সামনে এলে তিনি তাতে আঘাত করেন। ফলে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে বর্শা তাক করে বসে থাকা ওয়াহশি সুযোগ মতো হামজার অগোচরে তার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে, যা তার নাভির নিচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। এরপরও তিনি তার দিকে তেড়ে যেতে লাগলে পড়ে যান এবং কিছুক্ষণ পরই শাহাদতবরণ করেন।
আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ওয়াহশিকে নির্দেশ দিয়েছিল, যেন হামজার কলিজা তার সামনে পেশ করা হয়। ওয়াহশি এই মর্মন্তুদ কা-টি ঘটিয়ে ফেলে। হামজার কলিজা নিয়ে সে হিন্দার কাছে এলে, এক হাতে সে কলিজাটি হস্তান্তর করে আর অন্য হাতে হিন্দ তার দামি গহনা ওয়াহশির হাতে সোপর্দ করে। এটা যে ওয়াহশির কীর্তির প্রতিদান ছিল!
এরপর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, বদর প্রান্তরে খুন হওয়া উতবার মেয়ে হিন্দ হামজার কলিজা চিবাতে আরম্ভ করে। সে এমন করে তার ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ আর হিংসার অনল নেভাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কলিজা তার গলায় আটকে যায়। সে কিছুতেই তা গিলতে সক্ষম হয় না। সে তা বাইরে নিক্ষেপ করে বলতে থাকেÑ ‘আমি তোমার কাছ থেকে বদরে নিহতদের প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। লড়াইয়ের পর লড়াই করা তো পাগলামির নামান্তর। আমি আমার বাবা উতবা, চাচা শাইবা এবং ভাই ও ছেলের মৃত্যুতে ধৈর্য সংবরণ করে রাখতে পারিনি। এখন আমার মন শান্ত হয়ে গেছে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে নিয়েছি। ওয়াহশি আমার ভেতরকার ক্ষোভ মিটিয়ে দিয়েছে।’ (রিজালুন হাওলার রাসুল : ২১৫-২১৬)।
মক্কা বিজয়ের পর পৃথিবীর বুকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলেন তিনি। হিন্দ ইবনে উতবা (রা.) এর কাছেও ইসলামের সত্যতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি কয়েকজন সত্যান্বেষী মহিলার সঙ্গে বোরকা আবৃত হয়ে হাজির হলেন দরবারে রেসালতে। আঁধার চিরে এলেন আলোর পথে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অমায়িক মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম কবুল করেন হিন্দ। সেদিন থেকে হিন্দ হলেন রাদিয়াল্লাহু আনহা।
তখন তিনি হৃদয়ের আবেগে উদ্বেলিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে বললেন, এর আগে কুফুরি অবস্থায় আপনার চেয়ে অধিক ঘৃণিত দুশমন আমার কেউ ছিল না। আর আজ আমার কাছে মনে হচ্ছে আপনার চেয়ে পরম প্রিয় দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। তিনি আবেগ আর চেপে রাখতে পারলেন না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এর চেয়ে মূল্যবান কিছু দরবারে রেসালতে দেয়ার মতো আপাতত তার কাছে নেই।
এরপর ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকেই মূর্তিগুলো সামনে পড়ল তার। ঈমানি জোশ খেলে গেল পুরো তনুমনে। সঙ্গে সঙ্গে সব মূর্তি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আজ সবচেয়ে বড় শত্রু তাকে মনে হলো। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার পর হজরত হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) নিজের জীবনকে সর্বাত্মকভাবে ইসলামের জন্য ওয়াকফ করে দেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, হজরত হিন্দ (রা.) ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী। অভিমানী তো বটেই। সেই সঙ্গে ছিল তার বুদ্ধিমত্তা। নিম্নের হাদিসে আমরা তার প্রমাণ পাই।
‘আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মুয়াবিয়া (রা.) এর মা হিন্দ আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলেন, আবু সুফিয়ান (রা.) একজন কৃপণ ব্যক্তি। এমতাবস্থায় আমি যদি তার মাল থেকে গোপনে কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি আমার গোনাহ হবে? তিনি বললেন, তুমি তোমার ও সন্তানদের প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ভাবে গ্রহণ করতে পারো।’ (মুসলিম : ১৭১৪)।
হজরত হিন্দ (রা.) আর কোনোদিন সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সরল পথ থেকে সরে যাননি। খলিফা ওমর (রা.) এর আমলে স্বামীর সঙ্গে তিনিও সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে বিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধে সুফিয়ান দম্পতির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এ যুদ্ধে রোমক সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ। সে ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা হবে ৩০-৪০ হাজার। মাঝে মাঝে মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু মহিলারা যুদ্ধসংগীত গেয়ে তাদের উৎসাহিত করতে থাকেন। এ ব্যাপারে হজরত হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) এর জুড়ি মেলা ভার। পলায়নপর যুদ্ধবিমুখ সৈন্যরা বস্তুত হিন্দ বাহিনীর প্রেরণাক্রমেই নব বলে বলীয়ান হয়ে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এতে যুদ্ধের গতি বদলে যেত। সাফল্যের স্বর্ণমুকুটে শোভিত হতো আরও একটি পালক। বলাবাহুল্য, ইয়ারমুক যুদ্ধে বিশাল রোমক বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়।  হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) ওমর (রা.) এর খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। জীবনের এ সময়টা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সেবায় সঁপে দেন। এক সময় মাওলায়ে কারিমের সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। আল্লাহ তায়ালা তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান, তাকেও সন্তুষ্ট রাখুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তার ঠিকানা করে দিন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

আঁধার চিরে আলোর পথে

আপডেট টাইম : ০৬:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ হিন্দ ইবনে উতবা (রা.) এর কাছেও ইসলামের সত্যতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি কয়েকজন সত্যান্বেষী মহিলার সঙ্গে বোরকা আবৃত হয়ে হাজির হলেন দরবারে রেসালতে। আঁধার চিরে এলেন আলোর পথে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অমায়িক মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম কবুল করেন হিন্দ

নিশ্চয় মানুষের অন্তরের অবস্থান মহান আল্লাহর কুদরতি হাতের দুই আঙুলের মাঝে। আল্লাহ তায়ালা যাকে যখন যেমন চান, তেমন করে থাকেন। হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) ইসলামের ইতিহাসের খুবই আকর্ষণীয় এক নারী চরিত্র। যিনি জীবনের এক পর্বে বাবা ও স্বামীর সঙ্গে সমানে ইসলামদ্রোহিতা চালিয়ে গেছেন। ইসলাম, মুসলমান ও নবী (সা.) এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছরেরও অধিক সময় চরম শত্রুতা করে গেছেন। জানমাল বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামবিদ্বেষের তরে। আরেক পর্বে এসে সর্বোতভাবে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন ইসলামের সেবায়। ফতহে মক্কার পর থেকে সম্পূর্ণ পাল্টে যান তিনি। আবির্র্ভূত হন ইসলামের নিষ্ঠাবতী সেবকরূপে।

কোনো সন্দেহ নেই, হজরত হিন্দ (রা.) ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী ও বুদ্ধিমতী। বক্তব্যে ছিলেন স্পষ্ট ও অকপট। তার বংশলতিকা হচ্ছেÑ হিন্দ বিনতে উতবা বিনতে রাবিয়া ইবনে আবদু মান্নাফ ইবনে আবদু শামস আল আবশামিয়া আল কারশিয়া। (তারিখে দিমাশক : ৪৩৭)। তিনি ইসলামের আগে ও পরে আরবের একজন বিশিষ্ট মহীয়সী নারী হিসেবে বিবেচিত এবং উমাইয়া খলিফা হজরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) এর আম্মাজান। রূপ, সৌন্দর্য, মতামত, সিদ্ধান্ত, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, ভাষার শুদ্ধতা ও অলংকার, সাহিত্য, কবিতা, বীরত্ব-সাহসিকতা ও আত্মসম্মানবোধের অধিকারিণী ছিলেন হিন্দ বিনতে উতবা। ইমাম যাহাবি বলেন, ‘হিন্দ ছিলেন কোরাইশ নারীদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় সুন্দরী ও জ্ঞানী।’ (তারিখুল ইসলাম : ৩/২৯৮)।
বিশ্ববাসীকে অন্ধকারের গভীর অমানিশা থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে এক সময় মক্কায় ইসলামের অভ্যুদয় হলো। পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত হিন্দ ইসলামের আহ্বানের প্রতি কর্ণপাত করেননি; বরং তার এ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে আল্লাহর রাসুল, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতায়। এ সময় শত্রুতা প্রকাশের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেননি তিনি। বদরযুদ্ধের সূচনাতেই হিন্দের বাবা, ভাই ও চাচা নিহত হয়। শুধু তাই নয়, পৌত্তলিক বাহিনীর ৭০ জন বাছা বাছা সৈনিকও নিহত হয়।
এ বিজয়ে মুসলমানরা যেমন দারুণ উৎফুল্ল হন তেমনই কোরাইশ বাহিনীর খবর মক্কায় পৌঁছলে সেখানের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই হয়ে যায় হতবাক। প্রথমে অনেকে সে খবর বিশ্বাস করতে পারেনি। পরাজিতরা যখন মক্কায় ফিরতে লাগল তখন খবরের যথার্থতা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ অবশিষ্ট রইল না। ঘটনার ভয়াবহতায় মক্কাবাসীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হিন্দ তেল-সুগন্ধির ধারে-কাছেও গেলেন না এবং আবু সুফিয়ানের শয্যা থেকেও দূরে থাকলেন। পরবর্তী ওহুদ যুদ্ধ পর্যন্ত মক্কাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর বদরে নিহতদের স্মরণে রচনা করলেন প্রচুর শোকগাথা। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কোরাইশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ওহুদ যুদ্ধের দামামা সন্নিকটে। তারা তাদের সব সৈন্যসামন্ত এবং সহযোগী গোত্র-গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধের জন্য এগোতে থাকে। কোরাইশ নেতারা তাদের প্রতিশোধের অভীষ্ট লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করে মাত্র দুইজন মানুষকে। তাদের একজন হচ্ছেন রাসুলুল্লাহ (সা.) আর অপরজন হচ্ছেন হজরত হামজা (রা.)।
কোরাইশরা রওনা হওয়ার আগে একজন লোক মনোনীত করল, যাকে হজরত হামজা (রা.) কে শেষ পরিণতিতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এই লোক ছিল একজন হাবশি। তীরবাজিতে ছিল সে খুব দক্ষ। কোরাইশরা তাকে শুধু এ দায়িত্ব দিয়েছে যে, সে যেন হামজাকে শিকার করে। তাকে তীরবিদ্ধ করে যাতে জীবনাবসান ঘটানো হয়। কোরাইশরা তাকে এ উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোনো দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেনি। যুদ্ধ যেদিকেই গড়াক, যে করেই হোক তুমি তাকে তীরবিদ্ধ করে মেরে ফেলতে ভুলবে না।
কোরাইশরা তাকে বহু বড় বড় পুরস্কারের লোভ দেখায়। তাকে মুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস দেয়। এই হাবশি লোকটির নাম ‘ওয়াহশি’। এরপর কোরাইশরা ওয়াহশিকে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবার কাছে সোপর্দ করে দেয়, যাতে সে তাকে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মনোবল বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। কোরাইশরা লড়াইয়ে বের হওয়ার কয়েক দিন আগ থেকে হিন্দ তার পূর্ণ ক্ষোভ, দুঃখ, হিংসা আর প্রতিশোধস্পৃহা ওয়াহশির মনে গভীরভাবে গেঁথে দেয়। হামজাকে খুন করার বিনিময়ে বিরাট বিরাট লোভনীয় পুরস্কারের অঙ্গীকার করা হয়। তাকে খুব মূল্যবান স্বর্ণ, রুপা ও মুক্তার অলংকার পুরস্কার দেয়ার লোভ দেখানো হয়। হিন্দ নিজের গলার হার, হাতের চুড়িসহ সব অলংকার ওয়াহশির সামনে বের করে দেয়। বলেÑ এসব কিছুই তুমি পাবে; তুমি শুধু এর বিনিময়ে আমাকে হামজার মস্তক উপহার দেবে।
দুনিয়ার সবচেয়ে দামি দামি অলংকারের মোহে পড়ে যায় ওয়াহশি। সে যুদ্ধের প্রহর গুনতে থাকে, আর তীর নিক্ষেপের অনুশীলন করতে থাকে। হামজাকে খুন করার কাজে কৃতকার্য হতে পারলে সে আজাদ হতে পারবে। এর বিনিময়ে কোরাইশের এক নেতা, নেতার স্ত্রী ও নেতার মেয়ের গলায় পরা দামি অলংকারও তার হাতে আসবে।
শেষে একদিন ওহুদ যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধেও হামজা (রা.) এর বীরত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। প্রতিপক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তিনি সিংহবিক্রমে লড়াই করছিলেন। তিনি দুই হাতে এমনভাবে তরবারি পরিচালনা করছিলেন যে, শত্রুপক্ষের কেউ তার সামনে টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এদিকে মক্কার নেতা যুবাইর ইবনে মুতইমের হাবশি গোলাম ওয়াহশি ইবনে হারব একটি ছোট বর্শা হাতে নিয়ে আড়ালে ওতপেতে বসেছিল হামজা (রা.) কে নাগালে পাওয়ার জন্য। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিবা ইবনে আবদুল ওজ্জা হামজার সামনে এলে তিনি তাতে আঘাত করেন। ফলে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। এদিকে বর্শা তাক করে বসে থাকা ওয়াহশি সুযোগ মতো হামজার অগোচরে তার দিকে বর্শা ছুড়ে মারে, যা তার নাভির নিচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। এরপরও তিনি তার দিকে তেড়ে যেতে লাগলে পড়ে যান এবং কিছুক্ষণ পরই শাহাদতবরণ করেন।
আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ওয়াহশিকে নির্দেশ দিয়েছিল, যেন হামজার কলিজা তার সামনে পেশ করা হয়। ওয়াহশি এই মর্মন্তুদ কা-টি ঘটিয়ে ফেলে। হামজার কলিজা নিয়ে সে হিন্দার কাছে এলে, এক হাতে সে কলিজাটি হস্তান্তর করে আর অন্য হাতে হিন্দ তার দামি গহনা ওয়াহশির হাতে সোপর্দ করে। এটা যে ওয়াহশির কীর্তির প্রতিদান ছিল!
এরপর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, বদর প্রান্তরে খুন হওয়া উতবার মেয়ে হিন্দ হামজার কলিজা চিবাতে আরম্ভ করে। সে এমন করে তার ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ আর হিংসার অনল নেভাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কলিজা তার গলায় আটকে যায়। সে কিছুতেই তা গিলতে সক্ষম হয় না। সে তা বাইরে নিক্ষেপ করে বলতে থাকেÑ ‘আমি তোমার কাছ থেকে বদরে নিহতদের প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। লড়াইয়ের পর লড়াই করা তো পাগলামির নামান্তর। আমি আমার বাবা উতবা, চাচা শাইবা এবং ভাই ও ছেলের মৃত্যুতে ধৈর্য সংবরণ করে রাখতে পারিনি। এখন আমার মন শান্ত হয়ে গেছে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে নিয়েছি। ওয়াহশি আমার ভেতরকার ক্ষোভ মিটিয়ে দিয়েছে।’ (রিজালুন হাওলার রাসুল : ২১৫-২১৬)।
মক্কা বিজয়ের পর পৃথিবীর বুকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। হজরত আবু সুফিয়ান (রা.) মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলেন তিনি। হিন্দ ইবনে উতবা (রা.) এর কাছেও ইসলামের সত্যতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি কয়েকজন সত্যান্বেষী মহিলার সঙ্গে বোরকা আবৃত হয়ে হাজির হলেন দরবারে রেসালতে। আঁধার চিরে এলেন আলোর পথে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অমায়িক মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম কবুল করেন হিন্দ। সেদিন থেকে হিন্দ হলেন রাদিয়াল্লাহু আনহা।
তখন তিনি হৃদয়ের আবেগে উদ্বেলিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে বললেন, এর আগে কুফুরি অবস্থায় আপনার চেয়ে অধিক ঘৃণিত দুশমন আমার কেউ ছিল না। আর আজ আমার কাছে মনে হচ্ছে আপনার চেয়ে পরম প্রিয় দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। তিনি আবেগ আর চেপে রাখতে পারলেন না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এর চেয়ে মূল্যবান কিছু দরবারে রেসালতে দেয়ার মতো আপাতত তার কাছে নেই।
এরপর ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকেই মূর্তিগুলো সামনে পড়ল তার। ঈমানি জোশ খেলে গেল পুরো তনুমনে। সঙ্গে সঙ্গে সব মূর্তি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আজ সবচেয়ে বড় শত্রু তাকে মনে হলো। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার পর হজরত হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) নিজের জীবনকে সর্বাত্মকভাবে ইসলামের জন্য ওয়াকফ করে দেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, হজরত হিন্দ (রা.) ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বশালিনী। অভিমানী তো বটেই। সেই সঙ্গে ছিল তার বুদ্ধিমত্তা। নিম্নের হাদিসে আমরা তার প্রমাণ পাই।
‘আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মুয়াবিয়া (রা.) এর মা হিন্দ আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলেন, আবু সুফিয়ান (রা.) একজন কৃপণ ব্যক্তি। এমতাবস্থায় আমি যদি তার মাল থেকে গোপনে কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি আমার গোনাহ হবে? তিনি বললেন, তুমি তোমার ও সন্তানদের প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ভাবে গ্রহণ করতে পারো।’ (মুসলিম : ১৭১৪)।
হজরত হিন্দ (রা.) আর কোনোদিন সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সরল পথ থেকে সরে যাননি। খলিফা ওমর (রা.) এর আমলে স্বামীর সঙ্গে তিনিও সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে বিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধে সুফিয়ান দম্পতির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এ যুদ্ধে রোমক সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ। সে ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা হবে ৩০-৪০ হাজার। মাঝে মাঝে মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু মহিলারা যুদ্ধসংগীত গেয়ে তাদের উৎসাহিত করতে থাকেন। এ ব্যাপারে হজরত হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) এর জুড়ি মেলা ভার। পলায়নপর যুদ্ধবিমুখ সৈন্যরা বস্তুত হিন্দ বাহিনীর প্রেরণাক্রমেই নব বলে বলীয়ান হয়ে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এতে যুদ্ধের গতি বদলে যেত। সাফল্যের স্বর্ণমুকুটে শোভিত হতো আরও একটি পালক। বলাবাহুল্য, ইয়ারমুক যুদ্ধে বিশাল রোমক বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়।  হিন্দ বিনতে উতবা (রা.) ওমর (রা.) এর খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকেন। জীবনের এ সময়টা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সেবায় সঁপে দেন। এক সময় মাওলায়ে কারিমের সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। আল্লাহ তায়ালা তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান, তাকেও সন্তুষ্ট রাখুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তার ঠিকানা করে দিন।