বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি জলাশয় থেকে পরিযায়ী পাখিরা চলে গেছে। বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতে, দর্শনার্থীদের ভিড়, গাড়ির হর্ন, ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের কোলাহলের কারণে পরিযায়ী পাখিরা (অনেকে অতিথি পাখিও বলেন) চলে গেছে। তবে ক্যাম্পাসের অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি একটি জলাশয়ে যেখানে মানুষের আনাগোনা নেই, সেখানে পাখিরা এখনো আছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সপ্তাহজুড়ে ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে শাড়ি কাপড়, খেলনা, পিঠা কেনাকাটা চলে। সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটির দিনে তা রীতিমতো হাটে রূপ নেয়। এতে তাঁদের শিক্ষা-গবেষণা ও দৈনন্দিন জীবন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
চলমান এ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছে। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ বলেন, এসব দোকানপাট এবং অগণিত দর্শনার্থীর সমাগম ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য ও শিক্ষার পরিবেশ দুটোই নষ্ট করছে। সবাইকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। তবে প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকেই।
চলে গেছে পরিযায়ী পাখি
প্রচুর গাছপালা ও ছায়াঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত। ছুটির দিনগুলোতে এখানে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। তাদের ব্যবহৃত খাবারদাবারের মোড়ক, ঠোঙা ও পলিথিন জলাশয়ের পানিতে ফেলায় জলজ প্রাণী এবং পরিযায়ী পাখির বিচরণের অনুপযোগী হয়ে উঠছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বছর অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ক্যাম্পাসের চারটি জলাশয়ে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। নভেম্বরের মধ্যে জলাশয়গুলো পাখিতে ভরে ওঠে। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতেই প্রধান তিনটি জলাশয় থেকে পরিযায়ী পাখি চলে গেছে। তবে শারীরিক শিক্ষা কার্যালয়সংলগ্ন জলাশয়ে কিছু পাখি থাকলেও প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে পরিবহন চত্বর এবং প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন জলাশয়ে কোনো পরিযায়ী পাখি দেখা যাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন কেন্দ্রসংলগ্ন একটি জলাশয়ে এখন পাখি আছে। জলাশয়টি বিশ্ববিদ্যালয়েরই। সেখানে মানুষের তেমন আনাগোনা নেই।
এ বিষয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ১৬-১৭ দিন ধরে পাখি নেই এসব জলাশয়ে। শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যাকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরাসহ যে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত দর্শনার্থী গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন, তাতে এ ক্যাম্পাসে পাখিদের জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে না। গাড়ির হর্ন এবং কোলাহলের কারণেই এ দুটি লেক থেকে পরিযায়ী পাখি চলে গেছে। অথচ এ বছর অন্যান্য বারের চেয়ে বেশি পাখি এসেছিল।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শীত মৌসুমে অক্টোবর-নভেম্বরে সাইবেরিয়া, চীন, কাশ্মীর আর হিমালয়ের আশপাশ থেকে পরিযায়ী পাখিগুলো আসে ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে। থাকে প্রায় মার্চ মাসের মাঝামাঝি অবধি। গড়ে ৬০ প্রজাতির পাখি দেখা যায় জলাশয়গুলোতে। যার অধিকাংশই পাতি সরালি। আর কিছু আছে রাজ সরালি। এ ছাড়া লেঞ্জা, বালি, ভূতি, গার্গেনি, খঞ্জনা অন্যতম।
জানতে চাইলে একই বিভাগের সভাপতি মো. মনোয়ার হোসেনও পাখি চলে যাওয়ার পেছনে প্রায় একই কারণ উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি পাখি আসার পর জলাশয়ের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমকেও দায়ী করেন। তিনি মনে করেন, এ কাজটি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পর আরও পরিকল্পিতভাবে করা উচিত ছিল।
সাপ্তাহিক হাট
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিনে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের টারজান পয়েন্ট, বটতলা, শহীদ রফিক-জব্বার হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রসংলগ্ন এলাকাগুলোতে অসংখ্য অবৈধ ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি দোকানপাট রয়েছে আল বেরুনী হলের মোড় থেকে ফজিলাতুন্নেসা হলের মোড় পর্যন্ত। চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে প্রায় দেড় শ মিটার দীর্ঘ এবং তিন মিটার প্রস্থ জায়গাজুড়ে শতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসে প্রতিদিন। এসব দোকানে শাড়ি কাপড়, খেলনা, পিঠা, চা-কফি, ফ্রায়েড চিকেন বিক্রি হয়।
এসব দোকানের ক্রেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলেও প্রধান ক্রেতা মূলত ক্যাম্পাসসংলগ্ন আমবাগান, গেরুয়া, ইসলামনগর এলাকার অধিবাসী এবং বহিরাগত দর্শনার্থীরা। রবি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকাল সাড়ে আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এসব দোকানে কেনাকাটা চলে। অন্যান্য দোকান সন্ধ্যার পর বন্ধ হলেও পিঠা, চা-কফি এবং ফ্রায়েড চিকেনের দোকানগুলো খোলা থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। এসবের কারণে চিকিৎসাকেন্দ্রের সামনে দিনজুড়ে ভিড় লেগেই থাকে। তবে সাপ্তাহিক ও ছুটির দিনে উপচে পড়া ভিড় থাকে।
এসব দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা কেউই প্রশাসন থেকে কোনো অনুমতি নেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দোকানদার জানান, চাঁদার বিনিময়ে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা তাঁদের এখানে দোকান নিয়ে বসতে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুখ্য উদ্যানতত্ত্ববিদ এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এস্টেট) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘এসব দোকানের কোনো অনুমতি নেই। কিন্তু আমরা উঠাতেও পারছি না তাদের। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।’
জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘এসব দোকানপাটের বিষয়ে আমরা অবগত। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। দ্রুত এর সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ পরিযায়ী পাখির বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু তাপমাত্রার তারতম্য হয়েছে। সে জন্য পাখি অন্যত্র যেতে পারে। দেখা যাক কিছু দিনের মধ্যে ফিরে আসে কি না।