বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সারা বছরই স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত সময় পার করেন দোহার তৈরির কারিগর ও দোহারপল্লী নামে খ্যাত তেলিপুকুর গ্রামের বাসিন্দারা। মহম্মদপুরের একটি নিভৃত গ্রামের নাম তেলিপুকুর। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ পরিবারের জীবন ও জীবিকা মিশে আছে মাছধরা যন্ত্র ‘দোহার’ তৈরির সঙ্গে। বাঁশের তৈরি দৈাহার তৈরি ও বিক্রি করে তেলিপুকুর গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার ভাগ্যবদল করেছেন। এ পেশার উপর নির্ভরশীল ওই গ্রামের ৯০ ভাগ পরিবার।
দোহার তৈরি ও বিক্রি লাভজনক হওয়ায় বংশ পরম্পরার এ পেশার সঙ্গে স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা ক্রমেই বাড়ছে। এ কর্মযজ্ঞ চলে সারা বছর। সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, স্বামী-স্ত্রী, কিশোর-কিশোরী ও শিশু শিক্ষার্থী-কেউই দোহার বানাতে অক্ষম নন। সব বয়সের মানুষই রপ্ত করেছেন দোহার বুননের কাজ। উপজেলার তেলিপুকুর গ্রামটি এখন ‘দোহারপল্লী’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। দোহার বুনন ও বিক্রির লাভের অর্থ দিয়ে এ পেশার ওপর নির্ভর পরিবারগুলো অভাব জয় করে নতুন করে সাঁজিয়ে তুলছেন সংসার।
দোহার পল্লীর কারিগরদের দক্ষ ও কর্মমুখী হাতে নিপুণভাবে তৈরি দোহার মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলার জেলেরা দোহার পল্লীতে এসে দোহার ক্রয় করে নিয়ে যান। উপজেলা সদর থেকে আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছায়াঢাকা গ্রামীণ জনপদ তেলিপুকুর। এ গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার সরাসরি জীবিকা নির্বাহ করেন দোহার তৈরি করে। বেঁচে থাকার তাগিদে বাঁশ ও সুতার সফল সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরি করা দোহারই হয়ে উঠেছে পল্লীবাসীদের অন্ন-বস্ত্র জোগানের অন্যতম মাধ্যম।
দোহার বুননের এ পেশাতে মহিলাদের মুখ্য ভূমিকায় মুখর হয়ে ওঠে দোহারপল্লী। বাঁশের শলাকা ও সুতার বাইনে (বাঁধনে) মিশে আছে পল্লীর বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা আর বিরহ-ভালোবাসা। ওদের অস্থিমজ্জায় নিবিড়ভাবে মিশে গেছে দোহার বুনন। দোহার বিক্রির লভ্যাংস দিয়ে সহস্রাধিক পরিবারের অন্নবস্ত্রের যোগান হয়। দোহার বুননের পেশাটি ওদেরকে যুগিয়েছে অদম্য শক্তি ও সাহস। স্থানীয় ইমারত মোল্যার ছেলে ও প্রথম শ্রেণির ছাত্র ওসমান, একই শ্রেণির ছাত্র ও দুলাল শেখের ছেলে মাহাবুল, মুক্তার শেখের মেয়ে ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সুবর্ণা, মুক্তার শেখ ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগম সকলেই একত্রে পাশাপাশি বসে দোহার বুনছেন।
আলাল শেখ বলেন, তিনি ৩০-৩৫ বছর ধরে দোহার বুননের কাজ করছেন। বাপ-দাদার পেশাটি বংশ পরস্পরায় ক্রমেই বাড়ছে। ৫৫ বছর ধরে দোহার বুনছেন আফতার মোল্যা। তার পুরো পরিবার দোহার তৈরি করেন। ১৯৯৬ সালে এ গ্রামের জালালের বধূ হয়ে আসেন মুক্তা। অল্প দিনের মাথায় ঘোমটা টানা নববধূর ঘোমটাও নেমে গেছে খানিকটা। তিনি স্বামীর কাছ থেকে দোহার তৈরি শিখেছেন। শুধু উল্লিখিত পরিবারগুলোই নয়- তেলিপুকুর গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের পেশা অভিন্ন।
দোহারপল্লীর বাসিন্দারা জানান, ১০০ দোহার তৈরির জন্য বাঁশ, প্লাস্টিকের রশি ও নাইলনের সুতাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। মানভেদে ১০০ দোহার বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ১০০ দোহার তৈরির উপকরণ ও শ্রম বাদ দিয়ে লাভ থাকে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। ৫ সদস্যের পরিবার ২ দিনেই ১০০ দোহার তৈরি করতে পারেন। ৭৫ বছর বয়সী দোহার তৈরির হস্তশিল্পী আফতাব মোল্যা জানান, আমাদের গ্রামের দোহারের চাহিদা ব্যাপক। দোহার বানিয়ে বিক্রির জন্য হাটেও নেয়া লাগে না।
আবার বসেও থাকা লাগে না। তিনি জানান, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার জেলে ও ব্যবসায়ীরা মোবাইলে অর্ডার দেন। টাকা পরিশোধ করেন বিকাশের মাধ্যমে। এরপর চাহিদা অনুযায়ী নৌ ও সড়কপথে দোহার পৌঁছে দেয়া হয়। উপজেলার দোহারপল্লীবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নের একমাত্র ও অন্যতম অবলম্বন দোহার তৈরি এবং বিক্রি। এ পেশার মাধ্যমেই তারা ভাগ্যবদল করেছেন। অভাব জয় করেছেন দোহার বুনে। দোহার বুননের সঙ্গেই মিশে আছে ওদের স্বপ্ন বুনন। দোহারপল্লীতে কেবল দোহার নয়- চলে স্বপ্ন বুনন।