গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও যানজট নিরসনে গত বুধবার থেকে চাল হয়েছে ‘ঢাকা চাকা’ নামের বাস সেবা এবং বিশেষ রঙের রিকশা।
‘ঢাকা চাকা’ কেমন চলছে দেখতে সরেজমিন গুলশান ১, ২ ও নতুন বাজারের তিনটি স্ট্যান্ডেই দেখা যায়, যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন। গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ এ ৪টি ও কাকলী থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত ৬টি মোট ১০টি ঢাকা চাকা নামের বাস চলাচল করছে।
গুলশান-১ গোল চত্ত্বরের কাছে ছোট একটা টেবিল নিয়ে রাস্তা মেরামতের সিমেন্টের ব্লকের উপর বসে ‘ঢাকা চাকা’র বাসের টিকেট বিক্রি করছেন মো. আলমগীর। টিকেট বিক্রির সময় যাত্রীদের বলে দিচ্ছেন বাস আসতে দেরি হবে এ কথা শুনে এবং লাইনে দাড়িয়ে থেকে অতিষ্ট হয়ে অনেকই টিকেট ফেরত দিয়ে কয়েকেজন মিলে সিএনজি ভাড়া করে চলে যাচ্ছেন গন্তব্যে।
গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলার পর গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় ফলে কূটনৈতিকপাড়া হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় নিয়মিত যাতায়াতকারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এমন একজন ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম পূর্বপশ্চিমকে বলেন, বাসে উঠতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। আর এতটা সময় অপেক্ষা করতে হয় ধৈর্য্য থাকে না।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে আসা শারমীন সুলতানা গুলশান-১ এ বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি বলেন, গুলশান- ২ এ সাড়ে ১২টায় একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। প্রায় ১ ঘন্টা হয়ে গেল লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক পুরুষ সিএনজি করে যাচ্ছে, আমি তাও পারছি না।
আরেকজন যাত্রী টিকেট ফেরত দিয়ে অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এসি বাস হওয়ায় ২ কিলো মিটার রাস্তার ভাড়া নিচ্ছে ১৫ টাকা। বাস তো আমাদের মতো মানুষের জন্য, যারা বাসায় এসি ব্যবহার করে না। সেখানে ৩ মিনিটের রাস্তার জন্য এসি বাস দেওয়ার দরকার কি! বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে ভাড়া কম রাখলে বুঝতাম সরকার জনগণের কথা বোঝে।
সকাল সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা চল্লিশ পযন্ত প্রায় ২৫ /৩০ জন টিকিট কিনে তা ফেরত দেন। সাড়ে ১১টার পর বাস আসে ১২ টা ৩৫ মনিটে এরপর আরেকটা বাস আসে ১২টা ৫৫মিনিটে ।
একদিকে বাস অপ্রতুল অন্যদিকে জ্যাম থাকায় ৫ মিনিটের রাস্তা আসতে প্রায় ৪০/ ৪৫ মিনিট লেগে যায় জানিয়ে টিকেট বিক্রেতা আলমগীর বলেন, যাত্রীর তুলনায় বাস কম হওয়ায় প্রতিটা বাসেই ১৩ /১৪ জন করে দাঁড়ানো যাত্রী থাকে ।
এদিকে কাকলী বাস স্ট্যান্ড থেকে ১৫ মিনিট পরপর ৩ টি বাস নতুন বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এখানে সময় নিয়ে যাত্রীদের কোনো অসন্তোষ না থাকলেও ভাড়া নিয়ে আছে ক্ষোভ ও অভিযোগ।
একজন যাত্রী বলেন, কাকলী থেকে গুলশান-২, নতুনবাজার পথে রবরব পরিবহন, বিহঙ্গ পরিবহন ও ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির বাস চলত। এই বাসগুলোতে কাকলী থেকে গুলশান-২ ও নতুনবাজারের ভাড়া নেওয়া হতো ৫ টাকা। তবে এসব বাস শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছিল না।
বাসগুলোতে মূলত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করেন। তাদের অভিযোগ আগে এপথে চলা বাসগুলোয় যে দূরত্বের ভাড়া নেওয়া হতো ৫ টাকা, নতুনবাসে নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। এ বিষয়টি দেখা দরকার।
অনেক সময় কাকলী থেকে বনানী বাজার ২ টাকা দিয়েও যাওয়া যেত এখন কোনো উপায় নেই পায়ে হাঁটা ছাড়া বল্লেন বনানী বাজারের দোকনী নিয়ামত আলী।
ঢাকা চাকার যাত্রী হিসেবে একজন মোটর মালিক সমিতির সদস্য বলেন গুলশান- ১ এর শ্যুটিং ক্লাব পয়েন্ট থেকে গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বরের দুরত্ব ৩ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)রাজধানীতে মিনিবাসের জন্য ভাড়া ঠিক করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৬০ পয়সা। সে হিসাবে এই পথের ভাড়া আসে ৪ টাকা ৮০ পয়সা। এসি বাস হওয়ায় এই রুটের ভাড়া হওয়া উচিত ৮ টাকা সেখানে না হয় ১০ টাকা নেবে।
তবে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে আরো ১০টি বাস নামবে বলে জানান ’ঢাকা চাকার’ অফিসে সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা হাবিব। তিনি বলেন, কেবল শুরু আমরা সব কিছু দেখছি আশা করা যায় ’ঢাকা চাকা’ সফলভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
এদিকে এ বিষয়ে বিহঙ্গ পরিবহনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই রুটে বিহঙ্গ পরিবহনের ৩০টি বাস চলাচল করতো। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বলে তা বন্ধ করে দেওয়ায় মালিকরা হতাশ। এখন তারা নতুন রুটে এই বাস সার্ভিস চালুর চিন্তা ভাবনা চলছে।
ট্রাস্ট পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আলী বলেন, ‘গুলশানে হামলার পর থেকে বাস ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু রবরব পরিবহনেরই ৬২টি বাস ছিল। এখন কয়েকটা এসি বাস দিয়ে সিটি করপোরেশন সার্ভিস চালু করল। যাত্রীসংখ্যার তুলনায় এই বাসের পরিমাণ খুবই কম।’
কাকলী থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত রবরব, ট্রাষ্ট, বিহঙ্গ ও গ্রামীন নামের প্রায় দেড়শ বাস চলতো। সেখানে মাত্র ১০ টি বাস দিয়ে কিভাবে যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করবে প্রশ্ন করে বিহঙ্গ বাসের চালক জাহিদুল।
প্রথম দফায় ৩৫ আসনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ১০টি বাস নিয়ে চালু হয়েছে ‘ঢাকা চাকা’ নামের এই বাস সেবা। মোটরগাড়ি সংযোজন ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপের পক্ষ থেকে বাস গুলো পরিচালনা করা হচ্ছে।
এদিকে বিশেষ বাস সেবার পাশাপাশি গুলশান বনানী বারিধারা এলাকায় বিশেষ রঙের ৫০০ রিকশাও চালু করা হয়। বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়া নির্ধারণ করে বানানো তালিকা হলুদ-কালো রঙের এ রিকশাগুলোয় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর রিক্সা চালকদের পরানো হয়েছে হলুদ কমলা বর্ডারের বিশেষ জ্যাকেট। সিটি করপোরেশন ও এসব এলাকার সোসাইটিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, এসব বিশেষ রিকশা ছাড়া অন্য রিকশা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, এই এলাকাগুলোতে আগের মতোই সাধারণ রিকশা চলছে। বরং হাজারো সাধারণ রিকশার ভিড়ে বিশেষ রিকশা চোখ পড়ে খুবই কম। বিশেষ রিকশার পেছনে সাঁটানো ভাড়ার তালিকা যাত্রীরা দেখছেন না। সর্বনিম্ন ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ১৫ টাকা। গুলশান-১ গোলচত্বর থেকে গুলশান-২-এর ভাড়া ২০ টাকা। তবে অন্যান্য সাধারণ রিকশার মতো বিশেষ রিকশার চালকেরাও এ দূরত্বে ২৫ থেকে ৩০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন।
সাধারণ রিক্সাচালক শহীদুল জানায় আগামীকাল থেকে এ এলাকায় তারা আর রিক্সা চালাতে পারবে না। তার কথার সূত্র ধরে অপর একজন সাধারন রিক্সার চালক হোসেন বলেন এই এলাকায় প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার রিক্সা চলতো সেখানে ৫শ রিক্সা দিয়ে চলবে কি করে।
দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি পূর্বপশ্চিমকে বলেন, রিক্সার বিষয়টি এখনো খুব জোড়ালো ভাবে দেখা হচ্ছে না। তবে ধীরে ধীরে সরানো হবে।
এ বিষয়ে গুলশান সোসাইটির মহাসচিব ওমর সাদাত বলেন, ৫০০ রিকশার সবগুলো এখনো নামানো সম্ভব হয়নি। তাই সাধারণ রিকশাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। অনেকেই অভিযোগ করছেন, অন্য রিকশাই বেশি, বিশেষ রিকশাও ভাড়া মেনে চলছে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি বিশেষ রিকশাগুলো নামলে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।