বিদিশা। যিনি বিদিশা এরশাদ নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনারও। এই বিষয়ের ওপর সিঙ্গাপুরে পড়াশোনাও করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি আবুবকর সিদ্দিকের কিশোরী মেয়ে বিদিশা ব্রিটিশ নাগরিক শিক্ষক-গবেষক উইলিয়ামকে বিয়ে করে লন্ডনে স্থিত হন। এরপর বাংলাদেশে ঘুরতে এসে তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে পরিচয়, সখ্য ও প্রেমে জড়িয়ে পড়েন- একপর্যায়ে এরশাদকে বিয়ে করে বনে যান বিদিশা এরশাদ। তাদের প্রেম-প্রণয় ছিল অনেকটা কালবৈশাখীর মতো আবার বিচ্ছেদও ঘটে টর্নেডোর গতিতে।
এর আগে ২০০০ সালে স্ত্রীর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিদিশা জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পর্যায়ক্রমে হন মহিলা পার্টির সভানেত্রী ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য। এসব পদধারী হয়ে তিনি জাতীয় পার্টির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। বিদিশার বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। দলের নেতাকর্মীরা তাকে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেত্রী হিসেবে সমীহ করতে শুরু করেন। গণমাধ্যমে বিদিশার নিউজের চাহিদাও পারদের মতো তরতর করে উঠতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে তিনি গড়ে তোলেন ‘মানচিত্র’ নামে একটি গবেষণা সেল। কিন্তু হঠাৎ করে বিদিশার জীবনে ছন্দপতন ঘটে। ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এরশাদের রাজনীতির বলি হন তিনি। ভেঙে যায় এরশাদ-বিদিশার সংসার। জেলে যেতে হয় তাকে। এ সময় পুত্র এরিখকে নিজের কব্জায় নিয়ে যান এরশাদ। স্বামী-সংসার হারিয়ে একাকী ক্ষুব্ধ বিদিশা ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ এবং ‘স্বৈরাচারের প্রেমপত্র’ নামে দুটি বই প্রকাশ করে আলোচনার ঝড় তোলেন। সাবেক স্বামী এরশাদের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা বহুল আলোচিত বিদিশা এখন অনেকটাই লোক চক্ষুর অন্তরালে। নিজস্ব ব্যবসা আর বিদিশা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েই তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাবেক স্বামী এরশাদের মৃত্যুর পর আবার তিনি রাজনীতির আলোয় চলে এসেছেন। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। যদিও গত বছর হঠাৎ বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ইফতার পার্টিতে বিদিশার উপস্থিতিতে এ গুঞ্জনের সূত্রপাত। এরই মধ্যে বিদিশা জাপায় সক্রিয় হতে দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে যোগাযোগও করেছেন। এমন সম্ভাবনার কথা বিদিশা নিজেও উড়িয়ে দেননি। তিনি এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির রাজনীতিই করবেন- এমন লক্ষ্য নিয়েই পার্টির নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করছেন বলেও জানিয়েছেন।
বিদিশা নিজের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভাবনা নিয়ে ‘নয়া দিগন্ত’র বিশেষ সংবাদদাতা আশরাফ আলীর সাথে তার গুলশানের বিদিশা ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে মরহুম এরশাদ, সন্তান এরিখ ও জাতীয় পার্টির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। এ সময় এ প্রতিনিধিকে সহযোগিতা করেন নয়া দিগন্তের অনলাইন রিপোর্টার ইকবাল মজুমদার তৌহিদ।
সাক্ষাৎকারে বিদিশা বলেছেন, এরিখ আমাদের প্রতিবন্ধী সন্তান। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এরিখকে ভীষণ ভালো বাসতেন। এরশাদের মৃত্যুর পর বাপের জন্য এরিখের বুকফাটা কান্না দেশবাসীকেও কাঁদিয়েছে। তার কান্না দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। অথচ বাপ হারানো এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে তার মায়ের কাছেও আসতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির লোভে আমার এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। এরিখকে নিয়ে এই নোংরা খেলা যারা খেলছে- তাদেরও সন্তান আছে। তাদের বিচারটা কিন্তু ভয়াবহ হবে। নির্যাতিত নারীদের বদদোয়া কিন্তু আল্লাহ সবার আগে কবুল করেন। যারা আমার ঘর ভেঙেছে- তাদের ঘর চলে গেছে, যারা আমার সন্তান নিয়ে খেলেছে- তাদের সন্তান নেই, আমাকে যারা বিদেশ পাঠাতে চেয়েছে- আজকে তারাই বিদেশে পড়ে আছে। যারা আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল- তারাই আজ জেলে পড়ে আছে। তিনি বলেন, যারা এরিখকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছেন- এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। বিদিশা বলেন, আমার প্রতিবন্ধী ছেলেকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবো। সাংবাদিক সম্মেলন করব, প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন করব। প্রয়োজনে আমি আইনের আশ্রয় নেবো।
নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু তুলে ধরা হলো :
নয়া দিগন্ত : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে আপনার পরিচয় প্রেম, প্রণয়, বিচ্ছেদ এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াÑ এসব বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বিদিশা : আসলে এরশাদের সাথে আমার সব কিছু প্রেম থেকেই শুরু, অর্থাৎ পজেটিভ দিয়ে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে নেগেটিভের দিকে গেছে। আবার নেগেটিভ থেকেও শেষের দিকে পজিটিভ হয়েছে। হ্যাঁ, শুরুতে তো আমি ওনার প্রেমে পড়েছিলাম, আমাকে ওইভাবে কনভিন্স করতে পেরেছিলেন। তখন আমি বিবাহিতা, এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের স্ত্রী। সেখানে আমার দুই সন্তানও আছে। আমি ইংল্যান্ড থেকে তখন দেশে এসেছিলাম। এরশাদ সাহেব মানুষকে দ্রুত কনভিন্স করতে পারতেন। আমি উনার প্রেমে পড়লাম, তারপর আমাকে বিয়েও করলেন। আসলে প্রেমের সময়টা বেশি দিন ছিল না, উনি আগেই ডিসিশন নিয়েই নিয়েছিলেন আমাকে বিয়ে করার। বিয়ে হলো, এরিখকে ঘিরে ভালোভাবে সংসারও ছিল। তারপরে রাজনীতিতে আমাকে উনিই এনেছেন। এরশাদ সাহেব নিজেই আমাকে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন। আমি রাজনীতি করার কথা কখনো ভাবিনি। এ দেশের রাজনীতির প্রতি আমার কোনো ধারণাও ছিল না, রাজনীতি বুঝতামও না। উনি আমাকে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করে দিয়েছেন। আর এটা করতে গিয়ে অটোমেটিকলি আমাকে পার্টিতে পদ দেয়া হয়। আমাকে মহিলা পার্টির সভাপতি, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং পরে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যও করা হয়। যেহেতু আমার বাইরে পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, লন্ডনে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছি। ভালো ইংরেজি জানি। মানুষের সাথে ওঠা বসা করতে পারতাম। এরশাদই আমাকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি পার্টির ফরেন সাইটগুলো দেখাশোনা করতাম। বহির্বিশ্বে জাতীয় পার্টিকে ইন্ট্রোডিউস বা রিপ্রেজেন্ট করার কাজগুলো আমি খুব ভালোভাবে করেছি। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বাসায় আসতেন, সবার সাথে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল এটা ওনার কারণেই হয়েছে। এভাবেই আমার রাজনীতিতে উত্থান।