ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে গেছে সেই বৈশাখী মেলা : ষাঁড়ের লড়াইও আর নেই

পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে কক্সবাজারের চকরিয়ার (পেকুয়াসহ) বিভিন্ন ইউনিয়নে বসতো মেলা। এই মেলায় বলি খেলা (কুস্তি) ও ষাঁড়ের লড়াই থেকে শুরু করে চলতো নানা আয়োজন।

সরকারি উদ্যোগে না হলেও তৎকালীন নামকরা ব্যক্তিরা এলাকায় এসব মেলার আয়োজন করতো। মেলায় আগমন ঘটতো হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের। এক কথায় বলতে গেলে এসব মেলা সববয়সী নারী-পুরুষের সরব উপস্থিতিতে পরিণত হতো মিলন মেলায়। কিন্তু এখন সাড়া জাগানো সেই মেলা আর বসেনা। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এসব মেলা হারিয়ে গেছে । তবে এখন বৈশাখ মাস আসলেই চলে অপসংস্কৃতি।

সেখানে মেলার নামে বসানো হয় জুয়ার আসর। অবশ্য মাতামুহুরী নদীতীরের পৌরসভার দিগরপানখালী গ্রামের কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রপাল মন্দিরের আয়োজনে তৎসংলগ্ন এলাকায় পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও বসবে মেলা। কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রপাল মন্দিরের সভাপতি ডা. দিলীপ চৌধুরী মণি দৈনিক আজাদীকে বলেন, এবারসহ এই মেলাটি ১০৪ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। দুইদিনব্যাপী এই মেলায় বসবে নাগরদোলা, বেচাবিক্রি হবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির তৈরি খেলনা, চাটাই, সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। মেলার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম এমএ ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম লিটুর।

অবিভক্ত চকরিয়ার হারিয়ে যাওয়া সেই মেলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা ও সমাজ সংস্কারক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন কন্ট্রাক্টর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমান পৌর এলাকার বাসঘাটাস্থ মাতামুহুরী নদীর তীরে পহেলা বৈশাখের দিন বসতো এ ধরনের মেলা।

এই মেলায় চলতো বলি খেলা ও গরুর লড়াই থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। সম্ভবত ১৯৫০ সাল থেকে এই মেলা শুরু হয়। ১৯৫৩ সালের দিকে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন থেকেই এই মেলায় যাওয়া শুরু হয় আমার এবং দীর্ঘদিন ধরে এই মেলার প্রচলন ছিল।’কি কারণে এ ধরনের মেলা বন্ধ হয়ে গেছে? জানতে চাইলে প্রবীণ এই ব্যক্তি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অবিভক্ত চকরিয়ার আসন থেকে (চকরিয়া-পেকুয়া) মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া কেউই বিজয়ী হতে পারেনি। তখন থেকেই চকরিয়ায় মৌলবাদি ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই বার বার বিজয়ী হয়ে এসেছে। এ কারণেই বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এ ধরনের মেলার উপরও খড়্‌গ নেমে আসে।’

তিনি জানান, তবে এ ধরনের সংস্কৃতি বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই। মূলত মৌলবাদি গোষ্ঠীকে খুশি করতে পরিকল্পিতভাবে একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় বাঙালির সব প্রাণের উৎসব। এ থেকে বাদ পড়েনি কাকারার প্রসিদ্ধ জমিদার প্রয়াত মাওলানা বদিউজ্জামান চৌধুরী প্রবর্ত্তিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহি ঘোড়দৌড় মেলাও। অবশ্য স্থানীয় কর্তৃত্ব ও দ্বন্দ্বের কারণে সেই ঘোড়দৌড় মেলা বর্তমানেও বন্ধ রয়েছে।

এ ধরনের মেলা বন্ধ থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চকরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র অধ্যাপক রাহগীর মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ আসলেই ছোট-বড় সকলের মাঝে বয়ে যেত আনন্দের বন্যা। মেলায় যাওয়া ছাড়াও বৈশাখী পোশাক গায়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে গিয়ে খাওয়া হতো হাতের তৈরি রকমারী নাস্তা।

জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকযুগ আগেও অবিভক্ত চকরিয়া (পেকুয়া উপজেলাসহ) উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলতো এ ধরনের মেলা। তখনকার সময়ে এসব মেলা ছিল এলাকায় সাড়া জাগানো। তন্মধ্যে অনুসন্ধানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মেলার নাম উঠে এসেছে। তা হলো বর্তমান পৌর এলাকার বাসঘাটাস্থ এলাকার নামকরা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সর্বজনীন মাতামুহুরী নদীর তীরের বৈশাখী মেলা। চিরিঙ্গার বদর মিয়ার, ঘনশ্যাম বাজারের আবদুল হাকিম সওদাগরের ও পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের ছৈয়দ আহমদ ওয়ারেচির বৈশাখী মেলা। এসব মেলাকে ঘিরে তখনকার সময়ে সাজ সাজ রব পড়ে যেত এলাকায়। দূর-দূরান্ত থেকে এলাকার মেয়েরাও নাইয়র আসতো।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

হারিয়ে গেছে সেই বৈশাখী মেলা : ষাঁড়ের লড়াইও আর নেই

আপডেট টাইম : ০৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ এপ্রিল ২০১৭

পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে কক্সবাজারের চকরিয়ার (পেকুয়াসহ) বিভিন্ন ইউনিয়নে বসতো মেলা। এই মেলায় বলি খেলা (কুস্তি) ও ষাঁড়ের লড়াই থেকে শুরু করে চলতো নানা আয়োজন।

সরকারি উদ্যোগে না হলেও তৎকালীন নামকরা ব্যক্তিরা এলাকায় এসব মেলার আয়োজন করতো। মেলায় আগমন ঘটতো হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের। এক কথায় বলতে গেলে এসব মেলা সববয়সী নারী-পুরুষের সরব উপস্থিতিতে পরিণত হতো মিলন মেলায়। কিন্তু এখন সাড়া জাগানো সেই মেলা আর বসেনা। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এসব মেলা হারিয়ে গেছে । তবে এখন বৈশাখ মাস আসলেই চলে অপসংস্কৃতি।

সেখানে মেলার নামে বসানো হয় জুয়ার আসর। অবশ্য মাতামুহুরী নদীতীরের পৌরসভার দিগরপানখালী গ্রামের কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রপাল মন্দিরের আয়োজনে তৎসংলগ্ন এলাকায় পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও বসবে মেলা। কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রপাল মন্দিরের সভাপতি ডা. দিলীপ চৌধুরী মণি দৈনিক আজাদীকে বলেন, এবারসহ এই মেলাটি ১০৪ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। দুইদিনব্যাপী এই মেলায় বসবে নাগরদোলা, বেচাবিক্রি হবে গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাটির তৈরি খেলনা, চাটাই, সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। মেলার উদ্বোধন করার কথা রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম এমএ ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম লিটুর।

অবিভক্ত চকরিয়ার হারিয়ে যাওয়া সেই মেলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা ও সমাজ সংস্কারক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন কন্ট্রাক্টর দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমান পৌর এলাকার বাসঘাটাস্থ মাতামুহুরী নদীর তীরে পহেলা বৈশাখের দিন বসতো এ ধরনের মেলা।

এই মেলায় চলতো বলি খেলা ও গরুর লড়াই থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। সম্ভবত ১৯৫০ সাল থেকে এই মেলা শুরু হয়। ১৯৫৩ সালের দিকে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন থেকেই এই মেলায় যাওয়া শুরু হয় আমার এবং দীর্ঘদিন ধরে এই মেলার প্রচলন ছিল।’কি কারণে এ ধরনের মেলা বন্ধ হয়ে গেছে? জানতে চাইলে প্রবীণ এই ব্যক্তি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অবিভক্ত চকরিয়ার আসন থেকে (চকরিয়া-পেকুয়া) মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া কেউই বিজয়ী হতে পারেনি। তখন থেকেই চকরিয়ায় মৌলবাদি ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই বার বার বিজয়ী হয়ে এসেছে। এ কারণেই বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এ ধরনের মেলার উপরও খড়্‌গ নেমে আসে।’

তিনি জানান, তবে এ ধরনের সংস্কৃতি বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই। মূলত মৌলবাদি গোষ্ঠীকে খুশি করতে পরিকল্পিতভাবে একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় বাঙালির সব প্রাণের উৎসব। এ থেকে বাদ পড়েনি কাকারার প্রসিদ্ধ জমিদার প্রয়াত মাওলানা বদিউজ্জামান চৌধুরী প্রবর্ত্তিত শত বছরের ঐতিহ্যবাহি ঘোড়দৌড় মেলাও। অবশ্য স্থানীয় কর্তৃত্ব ও দ্বন্দ্বের কারণে সেই ঘোড়দৌড় মেলা বর্তমানেও বন্ধ রয়েছে।

এ ধরনের মেলা বন্ধ থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চকরিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র অধ্যাপক রাহগীর মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ আসলেই ছোট-বড় সকলের মাঝে বয়ে যেত আনন্দের বন্যা। মেলায় যাওয়া ছাড়াও বৈশাখী পোশাক গায়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে গিয়ে খাওয়া হতো হাতের তৈরি রকমারী নাস্তা।

জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকযুগ আগেও অবিভক্ত চকরিয়া (পেকুয়া উপজেলাসহ) উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলতো এ ধরনের মেলা। তখনকার সময়ে এসব মেলা ছিল এলাকায় সাড়া জাগানো। তন্মধ্যে অনুসন্ধানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মেলার নাম উঠে এসেছে। তা হলো বর্তমান পৌর এলাকার বাসঘাটাস্থ এলাকার নামকরা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সর্বজনীন মাতামুহুরী নদীর তীরের বৈশাখী মেলা। চিরিঙ্গার বদর মিয়ার, ঘনশ্যাম বাজারের আবদুল হাকিম সওদাগরের ও পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের ছৈয়দ আহমদ ওয়ারেচির বৈশাখী মেলা। এসব মেলাকে ঘিরে তখনকার সময়ে সাজ সাজ রব পড়ে যেত এলাকায়। দূর-দূরান্ত থেকে এলাকার মেয়েরাও নাইয়র আসতো।