ঢাকা , রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝুঁকিপূর্ণ ভোক্তা ঋণে ব্যাংকগুলো: এক বছরে বিতরণ বেড়েছে সাত হাজার কোটি টাকা

ঋণের প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ভোক্তা ঋণের সীমা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ব্যক্তিগত ঋণসহ বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটায় জামানতবিহীন ঋণসীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আর জামানত নিয়ে ভোক্তাকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া যাবে, আগে যা ছিল ১০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ব্যাংকগুলো। বিপুল পরিমাণের অলস টাকা পড়ে থাকায় ভোক্তা ঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। আর ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণের সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর ’১৬ শেষে ভোক্তা খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা, যা আগের বছর শেষে ছিল ৪৯ হাজার ২৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত এক বছরে ভোক্তা খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমানত সংগ্রহে সুদহার কমায় সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের ঋণ বিতরণেও সুদহার কমেছে। কিন্তু ভোক্তা খাতে দেওয়া ঋণগুলোর বেশির ভাগই বিতরণ হয়েছে উচ্চ সুদহারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর শেষে ৩০ শতাংশ সুদহারে বিতরণ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আর ১৮ শতাংশে বিতরণ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আর বাকি অর্থও বিভিন্ন সুদহারে বিতরণ হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণভাবে ভোক্তা ঋণ বা কেনাকাটার ঋণ অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহার হয়। ভোক্তা ঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে অর্থনীতিবিদরা এ ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষে মত দেন। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে। যদিও ব্যাংকগুলো এ ঋণ দিতে আগ্রহী থাকে। কেননা উত্পাদনশীল খাতে ঋণের চেয়ে ভোক্তা ঋণের সুদহার অন্তত ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি থাকে। যেমনটি বর্তমানে শিল্প খাতে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া গেলেও ভোক্তা ঋণ নিতে ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, উত্পাদনশীল খাতে ঋণ চাহিদা বেশি থাকলে ভোক্তা ঋণকে নিরুত্সাহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বিভিন্নভাবে এ ধরনের ঋণের সীমা আরোপ করে দেওয়া হয়। তবে আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে এখন প্রচুর অলস অর্থ পড়ে আছে। একই সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব ঋণ নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধির হারে একটা সীমা বেঁধে সতর্কতা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের মোট ঋণের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, ভোক্তা ঋণ মূল্যস্ফীতিকে কিছুটা উসকে দিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এর তেমন কোনো বিকল্প নেই। কেননা ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘদিন অলস অর্থ পড়ে থাকলে আমানত সংগ্রহের প্রতি তারা আগ্রহ একেবারে হারিয়ে ফেলবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য পড়ে আছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পরিস্থিতি চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। আর ভোক্তা ঋণ অনুপাত একবারে খুব একটা বাড়ানোও ঠিক হবে না। পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণ প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা এখনও কার্যকর রয়েছে। তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর ’১৬ শেষে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর শেষে ছিল ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ শতাংশ। যেখানে ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। তবে চলতি বছরে এসে ব্যাংকগুলোর ভোক্তা ঋণের আগ্রহ এত বেশি বেড়েছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।    ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি কিছুটা মুনাফা করতে কেউ কেউ আগ্রাসী বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তা ঋণ অনেকটা জামানতবিহীন ঋণ। এ ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকির পরিমাণও বাড়ছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় এর বিকল্পও তারা দেখছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশে ক্রেডিট কার্ডের ঋণসীমাও বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে বিনা জামানতে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে। এতদিন এ ধরনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা ঋণ দিত ব্যাংক।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ঝুঁকিপূর্ণ ভোক্তা ঋণে ব্যাংকগুলো: এক বছরে বিতরণ বেড়েছে সাত হাজার কোটি টাকা

আপডেট টাইম : ০৫:৪৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

ঋণের প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ভোক্তা ঋণের সীমা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ব্যক্তিগত ঋণসহ বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটায় জামানতবিহীন ঋণসীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আর জামানত নিয়ে ভোক্তাকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া যাবে, আগে যা ছিল ১০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ব্যাংকগুলো। বিপুল পরিমাণের অলস টাকা পড়ে থাকায় ভোক্তা ঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। আর ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণের সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর ’১৬ শেষে ভোক্তা খাতে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৫ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা, যা আগের বছর শেষে ছিল ৪৯ হাজার ২৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত এক বছরে ভোক্তা খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা বা ১৪ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমানত সংগ্রহে সুদহার কমায় সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের ঋণ বিতরণেও সুদহার কমেছে। কিন্তু ভোক্তা খাতে দেওয়া ঋণগুলোর বেশির ভাগই বিতরণ হয়েছে উচ্চ সুদহারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর শেষে ৩০ শতাংশ সুদহারে বিতরণ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আর ১৮ শতাংশে বিতরণ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ। আর বাকি অর্থও বিভিন্ন সুদহারে বিতরণ হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণভাবে ভোক্তা ঋণ বা কেনাকাটার ঋণ অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহার হয়। ভোক্তা ঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে অর্থনীতিবিদরা এ ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষে মত দেন। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে। যদিও ব্যাংকগুলো এ ঋণ দিতে আগ্রহী থাকে। কেননা উত্পাদনশীল খাতে ঋণের চেয়ে ভোক্তা ঋণের সুদহার অন্তত ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি থাকে। যেমনটি বর্তমানে শিল্প খাতে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া গেলেও ভোক্তা ঋণ নিতে ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, উত্পাদনশীল খাতে ঋণ চাহিদা বেশি থাকলে ভোক্তা ঋণকে নিরুত্সাহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বিভিন্নভাবে এ ধরনের ঋণের সীমা আরোপ করে দেওয়া হয়। তবে আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে এখন প্রচুর অলস অর্থ পড়ে আছে। একই সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব ঋণ নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধির হারে একটা সীমা বেঁধে সতর্কতা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের মোট ঋণের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সকালের খবরকে বলেন, ভোক্তা ঋণ মূল্যস্ফীতিকে কিছুটা উসকে দিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এর তেমন কোনো বিকল্প নেই। কেননা ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘদিন অলস অর্থ পড়ে থাকলে আমানত সংগ্রহের প্রতি তারা আগ্রহ একেবারে হারিয়ে ফেলবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য পড়ে আছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পরিস্থিতি চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। আর ভোক্তা ঋণ অনুপাত একবারে খুব একটা বাড়ানোও ঠিক হবে না। পর্যালোচনায় দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তা ঋণ প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা এখনও কার্যকর রয়েছে। তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর ’১৬ শেষে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর শেষে ছিল ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ শতাংশ। যেখানে ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। তবে চলতি বছরে এসে ব্যাংকগুলোর ভোক্তা ঋণের আগ্রহ এত বেশি বেড়েছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।    ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি কিছুটা মুনাফা করতে কেউ কেউ আগ্রাসী বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তা ঋণ অনেকটা জামানতবিহীন ঋণ। এ ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকির পরিমাণও বাড়ছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় এর বিকল্পও তারা দেখছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশে ক্রেডিট কার্ডের ঋণসীমাও বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে বিনা জামানতে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে। এতদিন এ ধরনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা ঋণ দিত ব্যাংক।