একুশ শতকেও গো মূত্রে চুমুক

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ নিষ্ঠা ভরে, খালি পেটে। সকালে চার ছিপি। রাতেও চার। প্রতিদিন এমন সময় বেঁধে, নিয়ম করে খাঁটি দেশি গোমূত্র পান করলে নাকি শরীরে বাসা বাঁধবে না কোনও রোগ! করোনাভাইরাস তো কোন ছার!

দেশি গোমাতার মূত্রের এই মাহাত্ম্য প্রচারেই শনিবার খাস দিল্লির বুকে ‘গোমূত্র পার্টি’র আয়োজন করেছিল অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা।

পার্টিই বটে!

কল লাগানো স্টিলের পাত্র। গায়ে লেখা ‘পবিত্র গোমূত্র প্রসাদম’। অর্থাৎ, পবিত্র প্রসাদী গোমূত্র। পাশে উপুড় করে রাখা মাটির ভাঁড়। এক জন করে আসছেন আর ভাঁড় ভরে চুমুক দিচ্ছেন সেই প্রসাদী তরলে। অনেকের আশ যেন আর মেটে না! ভাঁড় খালি হতেই হাঁক পাড়ছেন, আউর লাও!

মাঝেমধ্যে খোঁজ পড়ছে পায়েসের বালতি হাতে ঘুরে বেড়ানো রাজেশ কুমারের। যেন ‘স্টার্টার’। রাজেশ বললেন, ‘‘রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানো পঞ্চগব্য মেশানো আছে এই পায়েসে। গোবর, গোমূত্র ইত্যাদি। করোনাভাইরাসের সাধ্য কী যে কাছে ঘেঁষে!’’ কথা শেষ না-হতেই পাশ থেকে হাত বাড়ালেন ‘ভক্ত’। অনুরোধ এল, ‘‘আর একটু।’’

চা-কফি নেই। কড়া নেশার সামগ্রী নেই। তবু কথা কাটাকাটি চোখে পড়ল এই পার্টিতেও। সবে মাটির ভাঁড়ে গোমূত্রে ভরে ‘চিয়ার্স’ বলেছিলেন আমন বাজপেয়ী। কড়া ধমক দিলেন পাশে দাঁড়ানো ব্যোমব্যোম ঠাকুর। বললেন, ‘‘চিয়ার্স আবার কী? এ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নাকি?’’ ভাঁড়ে ভাঁড় মেলানো বন্ধ হল। কিন্তু তা বলে পানে টান পড়ার লক্ষণ নেই।

‘চুমুক’ দেওয়ার জন্য গোমূত্র ভরা পাত্র রাখা ছিল করোনাসুর থুড়ি করোনাভাইরাসের পোস্টারের সামনেও। সারা বিশ্ব যার ভয়ে সিঁটিয়ে, গোমূত্র ভরা পাত্র দেখে সে নিজেও তখন ভয় পেয়েছিল কি না

কে জানে!

হিন্দু মহাসভার অধ্যক্ষ চক্রপাণি মহারাজ বললেন, ‘‘চীনে জীবহত্যার পাপ চরমে। করুণার আকাল। তা থেকেই করোনাসুরের জন্ম। সকালে পঞ্চগব্য, গোমূত্রের ভোগ দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রার্থনা করা হয়েছে শান্ত হতে।’’

তামাম দুনিয়া এখনও প্রতিষেধক বার করতে পারেনি। রোগ ঠেকাতে নাকাল তাবড় ডাক্তারেরা। বিশ্ব জোড়া মহামারি বা অতিমারি হিসেবে একে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পুরো পৃথিবী ঘরবন্দি হওয়ার জোগাড়। সেখানে চক্রপাণির দাবি, ‘‘করোনাভাইরাসের মধ্যে ওয়াই-তত্ত্ব আছে। খুব ছোট। চোখে দেখা যায় না।

তাকে শায়েস্তা করতে যে গুণ লাগে, তা হাজির গোমূত্রে। সুতরাং…।’’ চুমুকের গতি বাড়ে চার পাশে! সুড়ুৎ। তবে বিদেশি গরু (মানে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের ভাষায় যারা ‘আন্টি’) হলে কিন্তু হবে না। হতে হবে খাঁটি দেশি। বাছুর হলে, আরও ভাল। মহাসভার নেতাদের তা-ই দাবি।

সারা পৃথিবী যে দাওয়াইয়ের খোঁজে হন্যে, তা চক্রপাণি মহারাজের ভাঁড়বন্দি। এমন আবিষ্কারকে পুরস্কার দেওয়ার লোভ কি নোবেল কমিটি ছাড়বে পারবে?

প্রশ্ন শুনে বিরক্ত মুখ আর বাঁকা চোখে দেব শরণ তিওয়ারির উত্তর, ‘‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো? চেখে দেখুন, তবে হবে। বাত থেকে দাঁতের পোকা, ক্যানসার থেকে করোনা— গোমূত্রে সারে না এমন কিছু নেই। চ্যালেঞ্জ। কুসুম গরম জলের সঙ্গে খেয়ে দেখুন।’’ বিশ্বাসে মন ভরে যেতে এক মিনিটও লাগেনি।

আলিগড় থেকে আসা এইচ এস মুটো খান পার্টিতে যোগ দিতেই ফের একদফা হইচই। তাঁর ঠোঁটে ভাঁড় ধরে চক্রপাণির দাবি, গোমাতার মাহাত্ম্যে মজেছেন মুসলিমও। দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির এই তো আসল ছবি।

হাতের কাছে এমন মহৌষধ থাকতে করোনার ত্রাসে বেঙ্গালুরুতে আরএসএস-এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের বৈঠক বাতিল করতে হল কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি। যেমন উত্তর নেই গোমূত্রে না-মজে কেন তা হলে সাধারণ মানুষকে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে মোদী সরকার? চক্রপাণির দাবি, ‘‘স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে আমাদের আর্জি, সমস্ত বিমানবন্দরে মদের দোকান বন্ধ হোক। চালু হোক গোমূত্র বিক্রি। বাইরে থেকে আসা সকলকে সেখানে গোবর মাখিয়ে শুদ্ধ করা হোক আগে।’’ ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ারের’ দিন কি তা হলে শেষ? ভাগ্যিস সফর সেরে ফিরে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বিজেপির এক নেতা অবশ্য বলছেন, কুসংস্কার ও তাকে ঘিরে অপপ্রচার সব ধর্মেই আছে। করোনাভাইরাসকে চীনের প্রতি আল্লাহের অভিশাপ বলেছেন এক মুসলিম ধর্মগুরু। বিজেপি সাংসদ তথা পশ্চিমবঙ্গে দলের সহ-সভাপতি এবং চিকিৎসক সুভাষ সরকারও বলেন, ‘‘গোমূত্র এবং গোবর খেলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যায় বলে আমার জানা নেই। এই দাবির পক্ষে কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ আছে বলেও মনে হয় না।’’

কিন্তু শোনে কে? পার্টি শেষে পাত পড়ল প্রসাদের। কচুরি, পনীরের তরকারি, পায়েস। যত্ন করে খাওয়াচ্ছিলেন গেরুয়াধারীরা। খাওয়া তখন মাঝপথে, হাসিমুখে এক গেরুয়াধারী জানালেন, ‘‘আপনারা ভাগ্যবান। এ যাত্রা করোনা আর ছুঁতে পারবে না আপনাদের। প্রসাদেও পঞ্চগব্য আছে কি না।’’

ভাঁড়ের পর ভাঁড় উড়ে যাওয়া তরল সত্যিই গোমূত্র কি না, পরখ করা শক্ত। কিন্তু এ কথা শুনে… দে দৌড়! সূত্র: আনন্দবাজার

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর