হাদিসের নির্দেশ না বান্দার ওপর আল্লাহর চার হক আদায়ে মিলবে পুরস্কার

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আবু সা‘লাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কিছু বিধান ফরজ করেছেন তা তোমরা নষ্ট করো না, কিছু সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা লঙ্ঘন কোরো না, কিছু বিষয় হারাম করেছেন তার নিকটবর্তী হয়ো না, কিছু বিষয়ে তোমাদের অবকাশ দিয়েছেন—তিনি তা ভুলে যাননি তা নিয়ে তোমরা বিতর্ক কোরো না। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ১৯৭২৫)

আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর বিধি-বিধান ও হালাল-হারাম মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যেসব বিষয়ে আল্লাহ বান্দাদের অবকাশ দিয়েছেন সেসব বিষয়ে তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। মূলত রাসুলুল্লাহ (সা.) বান্দার ওপর আল্লাহর চারটি হক বা অধিকারের বর্ণনা দিয়েছেন। তা হলো—ক. ফরজ বিধান মান্য করা, খ. দ্বিনের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করা, গ. হারাম থেকে দূরে থাকা, ঘ. যেসব বিষয়ে ইসলামী শরিয়ত কোনো বিধান নির্ধারণ করে দেয়নি সেসব ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা। ইমাম মুজনি (রহ.) বলেন, মহানবী (সা.) এই হাদিসে দ্বিনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি দিক তুলে ধরেছেন—সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে যা ইসলামী শরিয়তের সব বিধানকে অন্তর্ভুক্ত করে। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/৮১৮)

রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্য হাদিসে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, যা হারাম করেছেন তা হারাম এবং যে বিষয়ে চুপ রয়েছে তা ক্ষমাযোগ্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহর ক্ষমা লাভে অগ্রগামী হও। আল্লাহ কোনো কিছু ভোলেন না।’ (মুসতাদরিকে হাকিম, হাদিস : ৩৪১৯)

চার হক আদায়ের পুরস্কার
আল্লামা ইবনু সামআনি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই হাদিসের ওপর আমল করবে, পুরস্কারের যোগ্য হবে এবং শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। কেননা যে ফরজ আদায় করে, হারাম পরিহার করে, (দ্বিনের) সীমার ভেতরে জীবনযাপন করে এবং শরিয়ত যে বিষয়ে চুপ সে ব্যাপারে তর্ক পরিহার করে সে মর্যাদার স্তরগুলো অর্জন করল এবং দ্বিনের হক আদায় করল। কেননা শরিয়ত এই হাদিসে উল্লিখিত চারটি বিষয়ের বাইরে নয়। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/৮১৯)

ফরজ বা আবশ্যক বিধানের ব্যাখ্যা
ফরজ এমন বিধানকে বলা হয় যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। যা করলে তা পুণ্যের অধিকারী হয় এবং ত্যাগ করলে তার পাপ হয়। যেমন ঈমান, নামাজ, জাকাত, হজ ইত্যাদি। হাদিসে উল্লিখিত ‘ফরজ’ দ্বারা সব ধরনের ‘বিশ্বাসগত’ ও ‘কার্যত’ ফরজ বিধান এবং ‘ব্যক্তিগত’ (আইন) ও সামগ্রিক (কিফায়া) সব ধরনের ফরজ বিধান অন্তর্ভুক্ত। আর নষ্ট করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তা ছেড়ে দেওয়া, তার কোনো শর্ত ও রোকন ছেড়ে দেওয়া বা তা আদায়ে ইখলাস বা নিষ্ঠার অভাব থাকা, আমলের ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকা। তাত্ত্বিক আলেমরা বলেন, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হিসেবে আল্লাহ যে ইবাদতের কথা বলেছেন তা দ্বারা এই প্রকারের ইবাদত উদ্দেশ্য। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১/২৭৮)

হারামের ব্যাখ্যা
ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন, ‘হারাম দ্বারা উদ্দেশ্য যা শরিয়তের অকাট্য প্রমাণ দ্বারা হারাম প্রমাণিত। যেসব বিষয় শরিয়তের দলিল দ্বারা হারাম প্রমাণিত নয় তা নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়।’ (আত-তাবসিরাতু ফি উসুলিল ফিকহ, পৃষ্ঠা. ৮০-৮১)। কেননা ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি হলো প্রত্যেক বস্তু মৌলিকভাবে হালাল বা বৈধ; যদি না তা হারাম হওয়ার পক্ষে ইসলামী শরিয়তের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়। এ জন্য মহানবী (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি বড় অপরাধী যে এমন বিষয় প্রশ্ন করল যা মুসলমানের জন্য হারাম হয়নি, অতঃপর তার প্রশ্নের কারণে তা মুসলমানের জন্য হারাম হয়ে গেল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩৫৮)

মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর প্রশ্নের দ্বারা কোনো কিছু হারাম হওয়ার সুযোগ না থাকলেও এই হাদিস থেকে বস্তুর হালাল-হারাম নির্ণয়ে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়। তবে কোনো কাজ হারাম প্রমাণিত হলে তাতে লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, তাতে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে এমন কোনো কাজ করাও নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ৩২)

আল্লাহ সীমানা দ্বারা উদ্দেশ্য
আরবি ‘হদ’-এর ব্যাবহারিক অর্থ ‘নিষিদ্ধ অঞ্চল’। আল্লাহ তাআলা মানবজাতির জন্য যেসব বিষয় নিষিদ্ধ করেছেন হাদিসে সেসব বিষয় থেকে মানুষকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চাই সে হত্যা, ব্যভিচার ও ডাকাতির মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হোক অথবা অশ্লীলতা, মিথ্যা বলা ও পরনিন্দার মতো কাজ হোক—যার শাস্তি আল্লাহ পরকালে দেবেন। আল্লাহ পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে ‘সীমালঙ্ঘন’ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা আল্লাহর সীমানা—তার নিকটবর্তীও হয়ো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৭)

ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেন, এমন বৈধ কাজও আল্লাহর সীমাসংক্রান্ত সতর্কতার অন্তর্ভুক্ত হবে, যা হারামে লিপ্ত হওয়ার ভয় তৈরি করে। কেননা আল্লাহ চার বিয়ে করার ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছেন, ‘এটা আল্লাহর সীমা, সুতরাং তোমরা যা অতিক্রম কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২৯)

যেসব বিষয়ে বিতর্ক কাম্য নয়
আলোচ্য হাদিসে সেসব বিষয়ে বিতর্ক পরিহার করতে বলা হয়েছে যে ব্যাপারে ইসলামী শরিয়ত কোনো বিধান নির্ধারণ করে দেয়নি। আল্লাহ এসব বিষয় মানুষের জন্য অবকাশ হিসেবে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি যদি এসব কাজের ব্যাপারে কোনো বিধান দিতেন তবে তাতে মানুষের জীবনে সংকীর্ণতা তৈরি হতো। আল্লাহ যদি হারাম করতেন তাতে লিপ্ত হলে শাস্তি পেতে হতো এবং তা যদি আবশ্যক করতে তা ছেড়ে দিলেও তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। মহানবী (সা.) দ্বিনের ব্যাপারে সংকীর্ণতা তৈরি হয় এমন প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার বলেন, ‘মুতাআন্নিতুনদের জন্য ধ্বংস’। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৭০)

মুতাআন্নিতুন বলা হয় যারা কথা ও কাজে অর্থহীন অনুসন্ধান ও বাড়াবাড়ি করে এবং অনর্থক বিতর্কে লিপ্ত হয়। ইমাম আহমদ (রহ.)-কে প্রশ্ন করা হলো, অমুসলিমদের রং করা পোশাক না ধুয়ে পরা যাবে? তিনি বলেন, এই বিষয়ে প্রশ্ন কোরো না যতক্ষণ না মানুষ তা অপছন্দ করতে শুরু করে। (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/৮৪০-৪১)

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর