অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডদের পদায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না

কঠোর হুঁশিয়ারি এবং সতর্কবার্তায়ও আওয়ামী লীগের তৃণমূল কমিটিগুলোতে অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডদের পদায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে চলমান জেলা-মহানগর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সুযোগে ও স্থানীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নানা অপকর্মে যুক্ত এবং বিতর্কিত ব্যক্তিও ঢুকে পড়ছেন দলের মধ্যে। সভাপতি বনাম সাধারণ সম্পাদক দ্বন্দ্বে দলভারী করার প্রচেষ্টায় ‘পকেট কমিটি’ও হচ্ছে কোথাও কোথাও। ত্যাগীদের কোণঠাসা করে আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের কমিটিতে পদায়ন করতে ব্যস্ত অনেক নেতাই। কোথাও কোথাও নেতৃত্বের ‘জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের’ অভিযোগও উঠছে।

ক্ষমতাসীন দলের গত জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের আগে-পরে অনুষ্ঠিত সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে এ চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। বিবদমান এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে পদায়ন বাণিজ্যের মতো গুরুতর অভিযোগও তুলেছে। অবশ্য দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত আটটি বিভাগীয় টিমের চুলচেরা যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কমিটিই চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে না কিংবা ঘোষণা হবে না বলেও জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শিগগিরই দলের জেলা ও মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। এখন কমিটি যাচাই-বাছাই চলছে। কমিটির বিষয়ে কোনো বিষয়ে তথ্যভিত্তিক অভিযোগ থাকলে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সংগঠনের গঠনতন্ত্রের কাঠামোর আওতায় এ-সংক্রান্ত অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া যাবে। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে নিষ্পত্তি করবে। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে গঠনতান্ত্রিক এমন বিধান অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

গত বছরের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে-পরে দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৩১টি জেলা-মহানগর সম্মেলন হয়। এগুলো হচ্ছে- ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, সিলেট, সিলেট মহানগর, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা উত্তর, ফেনী, নোয়াখালী, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম উত্তর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, রংপুর মহানগর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী, রাজশাহী মহানগর, কুষ্টিয়া, যশোর, নড়াইল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, খুলনা মহানগর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরিশাল মহানগর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।

তবে এর পরপরই দেশে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ঘটলে অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জেলা সম্মেলন কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে করোনাসহ নানা কারণে গত ১১ মাসে কোনো কমিটিরই পূর্ণাঙ্গ রূপ ঘোষণা করা যায়নি। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশে দু’একটি বাদে প্রায় সব সাংগঠনিক জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নিজ নিজ জেলার ৭৫ সদস্যের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে জমা হওয়া প্রস্তাবিত কমিটিগুলো নিয়ে নানা লিখিত অভিযোগও কেন্দ্রে আসছে। যাচাই-বাছাই শেষে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার চূড়ান্ত অনুমোদন শেষে সব পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করার কথা রয়েছে।

প্রসংগত, গত ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জমা পড়া দলের সহযোগী ও জেলার প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি যাচাই-বাছাইসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে আটটি বিভাগীয় টিম গঠন করা হয়েছে। দলের চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আটজন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের এসব টিমের সমন্বয়ক করা হয়েছে। এছাড়া সভাপতিমণ্ডলী এবং সম্পাদকমণ্ডলী ছাড়াও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যদের যুক্ত করা হয়েছে এসব কমিটিতে। যদিও বেশিরভাগ টিমই প্রায় তিন সপ্তাহেও যাচাই-বাছাই কাজ শুরুই করতে পারেনি। আজ শনিবার খুলনা বিভাগের টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের এ-সংক্রান্ত বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।

প্রস্তাবিত জেলা ও মহানগর কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী ও নানা অপকর্মে জড়িতরা স্থান পাচ্ছেন- এমন অভিযোগ নিয়ে দলের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের আলোচনায় এমন নানা ঘটনা উঠে আসার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, নরসিংদীসহ বেশ কয়েকটি জেলার প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার কথা জানিয়ে নতুন করে কমিটি করার নির্দেশ দেন তিনি। এছাড়া কমিটি গঠনে ‘মাই ম্যান’ ও অনুপ্রবেশকারীরা যেন না থাকেন- সেটা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

দলীয় সূত্র বলছে, সম্মেলন হয়ে গেলেও রাজশাহী জেলা ও মহানগর, খুলনা, সিলেট জেলা ও মহানগর, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, হবিগঞ্জসহ বেশ কিছু সাংগঠনিক জেলা কমিটিতে দ্বন্দ্ব-কোন্দল রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের বেলায়ও এর প্রভাব পড়েছে। দ্বন্দ্ব-কোন্দলে জড়িত কোনো কোনো জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে আলাদা আলাদা কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে নোয়াখালী জেলা কমিটিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পদায়ন ঘটায় ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এখানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরীকে প্রস্তাবিত কমিটিতে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক পদ দেওয়ায় আত্মীয়করণের অভিযোগ উঠেছে ও সমালোচনা চলছে। শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র শহীদউল্লাহ খান সোহেলের অভিযোগ, ‘প্রস্তাবিত জেলা কমিটিতে প্রথমে জামায়াত ও পরে বিএনপি করেছেন, এমন লোককেও রাখা হয়েছে। গত কমিটির সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন অনেক ত্যাগী নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে এ কমিটি থেকে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মঈনুদ্দিন মণ্ডলের ছয়জন নিকটাত্মীয়কে জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মঈনুদ্দিন মণ্ডলের ভাই মর্তুজা আলীকে সহসভাপতি, ভাতিজা পারভেজ হাসান বাবুকে সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নাতি সামিউল হক লিটন, শ্যালিকা রানী বেগম ও ভায়রা মেসবাহুল হক জুয়েলকে সদস্য পদে প্রস্তাব করা হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও জানিয়েছেন, অনেক কমিটিতেই বিতর্কিতরা স্থান পেয়েছেন- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান এ প্রসঙ্গে বলেন, কখনও আওয়ামী লীগ করেনি, অথচ তাকে জেলা কমিটির বড় পদে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে! বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে এসেই কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন কেউ কেউ। আবার স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন- এমন নেতাদেরও কমিটিতে ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে- এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগও এসেছে বিভাগীয় টিমগুলোর কাছে।

দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন জানান, নানা কারণেই বিতর্কিতরা দলের বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় দলের অনেক নেতাও জড়িত থাকেন। তবে কেন্দ্রীয় বিভাগীয় টিমগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত ও অপরাধীদের বাদ দেবে। দলের আদর্শে বিশ্বাসী এবং প্রকৃত ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের নেতাকর্মীদের নিয়েই সব জেলা-মহানগর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর