রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশ কী করবে- আলী রীয়াজ

কয়েক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মুখে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। প্রথমে তাদের সংখ্যা কম ছিল, কিন্তু ক্রমেই তা বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের গ্রহণ করতে অনাগ্রহী এবং আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে দিচ্ছেন নাফ নদীতে। ২০১২ সালেও বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধ উপেক্ষা করে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অসম্মতি জানায়। বাংলাদেশ যেহেতু শরণার্থী-বিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি এবং জাতীয়ভাবে শরণার্থী-বিষয়ক কোনো আইন তৈরি করেনি, সেহেতু শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই যুক্তিতেই বাংলাদেশ তার অবস্থান তৈরি করেছে। ২০১২ সালের মতো এখনো এটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক সমাজের অনুরোধে কর্ণপাত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আক্ষরিকভাবে বিবেচনা করলে এটা ঠিক।  কিন্তু স্মরণ করা দরকার যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী। মানবাধিকার সনদে এটা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। এ ছাড়া ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবেও আশ্রয় প্রার্থনার প্রশ্নে বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো দেশে অত্যাচারের মুখোমুখি হবেন এমন আশঙ্কা থাকে, তবে ওই ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে বা বিতাড়নের মাধ্যমে কেবল সে দেশে পাঠানো যাবে না, এমনকি তাঁকে সীমান্তে প্রত্যাখ্যানও (রিজেকশন অ্যাট দ্য ফ্রন্টিয়ার) করা যাবে না। এই সব বিষয় যদিও বলা হয়েছে আশ্রয় প্রার্থনা বা অ্যাসাইলামের প্রশ্নে, তবু মর্মবস্তুর দিক থেকে বিবেচনা করলে এগুলো শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও সমভাবেই প্রযোজ্য। একইভাবে আমরা স্মরণ করতে পারি যে ১৯৮৪ সালের নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি প্রদানবিরোধী কনভেনশনে (কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার অ্যান্ড আদার ক্রুয়েল ইনহিউম্যান অর ডিগ্রেডিং ট্রিটমেন্ট অর পানিশমেন্ট) বলা হয়েছে, যদি এ কথা বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ থাকে যে কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো দেশে পাঠালে তার অত্যাচারের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তবে কোনো দেশ ওই ব্যক্তিকে বিতাড়ন, প্রত্যর্পণ, ফেরত পাঠানো বা তাকে প্রবেশে বাধা দিতে পারবে না।  বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালেই এই কনভেনশনে সম্মতি দিয়েছে। ফলে আইনগত দিক থেকে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের কোনো রকম বাধ্যবাধকতা নেই বলে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে এই আন্তর্জাতিক সনদগুলো, যার প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন ও আস্থা প্রকাশ করেছে, সেসব বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ আছে তার অসংগতির দিকও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এর বাইরে মানবিক দিক ও নৈতিক অবস্থান থেকেও শরণার্থীদের প্রশ্নটি বিবেচনা করতে হবে।  বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কার্যত তিনটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘটিত সেনা অভিযান সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত, ফলে আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া, যাতে করে এই ধরনের পরিস্থিতির সূচনা না হয়। দ্বিতীয়ত, অতীতে বাংলাদেশ যে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে তার একটি অংশ এখনো বাংলাদেশেই আছে। তৃতীয় যুক্তিটি জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু যেসব অসহায় রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সবাইকে কি এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায়?  বাংলাদেশ সরকারের এসব যুক্তি যদি সব দেশই ব্যবহার করে, তবে সারা পৃথিবীর যে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, তাদের কোথায় আশ্রয় হবে? যে এক কোটি মানুষের কোনো দেশই নেই, তাদের সামনে কী পথ খোলা থাকবে? গত বছর সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে যখন লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়িয়েছিল, সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছিল, তখন যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশগুলোর সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাই যখন নিজ দেশের দরজা বন্ধের পক্ষে যুক্তি দেন, তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। শরণার্থী ও অভিবাসীদের সবাইকে নিরাপত্তা ঝুঁকি বলে বর্ণনা করার প্রবণতা আমরা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের সরকার-সমর্থকেরা তাদের সমালোচনা করতে পিছপা হন না, কিন্তু একই ভাষায় কথা বলা এবং আচরণ করার ক্ষেত্রে তাঁরা যে পিছিয়ে নেই সেটা কি তাঁরা বুঝতে পারেন?  ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লিখিত ভাষণের কথা এখানে স্মরণ যায়: ‘শরণার্থী সমস্যা পাশ কাটিয়ে না গিয়ে অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বদেশ ও গন্তব্য দুই জায়গাতেই সম্ভাবনাময় পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।’ (ভোয়া বাংলা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন, কী অপরাধ ছিল সাগরে ডুবে যাওয়া সিরিয়ার তিন বছর বয়সী নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির? এখন একই ধরনের প্রশ্ন উঠতে পারে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এক দিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আয়োজিত লিডার্স সামিট অন রিফিউজিস-এ বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে।  এসব বলার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশের এই যুক্তিগুলোকে এককথায় নাকচ করে দেওয়া যায়। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমাজকে যুক্ত করতে চায়, তবে তা সহজতর হবে যদি এই শরণার্থীদের একাংশকে গ্রহণ করে এবং তাকে কেন্দ্র করেই চাপ সৃষ্টি করে। মিয়ানমার সরকার কফি আনানের নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্য-বিষয়ক যে উপদেষ্টা কমিশন গঠন করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারিভাবে আলোচনার দাবি তোলা দরকার। বাংলাদেশের পক্ষে এই চাপ সৃষ্টির অবকাশ অনেক বেশি থাকবে যদি সে শরণার্থীদের বিষয়ে যুক্ত থাকে। অতীতে যে শরণার্থীরা এসেছিল, তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল আন্তর্জাতিক সমাজের উদ্যোগে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কারণে। এবার কফি আনানের এই কমিশনের কারণে এর সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণের স্বার্থেই এখন থেকে শরণার্থীদের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। কিন্তু শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ না করে সেটা সম্ভব নয়। শরণার্থীদের বিষয়কে নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণা কার্যত আত্মঘাতী। কেননা, এতে শরণার্থীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে ইতিবাচক নয়। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা এই দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনায়ও সঠিক নয়। কেননা, বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জীবন রক্ষার তাগিদে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হচ্ছে, তাদের একত্রে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা না থাকলে তারা বাধ্য হয়েই সীমান্ত এলাকা থেকে সরে আসবে। আন্তর্জাতিকভাবে বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে শরণার্থী প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তখন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা এবং তাদের ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ আর থাকবে না। যাঁরা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে চান, তাঁদের জন্য এই ব্যবস্থাই হচ্ছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা।  সরকার এই বিপদগ্রস্ত শরণার্থীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দেখাতে চাইছে। সেটি অমানবিক হলেও সরকারের নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো কেন ‘শরণার্থী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’র মধ্যে পার্থক্যকে বিস্মৃত হয়েছে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। অনুপ্রবেশকারী কথাটার মধ্যে একটি রাজনীতি সুস্পষ্ট; ওই ব্যক্তির কার্যকলাপকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করাই এভাবে বর্ণনা করার লক্ষ্য। যেখানে গণমাধ্যমগুলো তাদের নিজেদের রিপোর্টেই জানাচ্ছে যে এই ব্যক্তিরা জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে দেশত্যাগ করছে। তাই তাদের এই ধরনের শব্দ ব্যবহার উদ্বেগজনক বলেই আমার ধারণা। এতে করে এই অসহায় মানুষের বিষয়ে সমাজে যে মনোভাব তৈরি হবে, তা ভবিষ্যতে বড় রকমের বিপদ ডেকে আনতে পারে। আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

Print Friendly, PDF & Email

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর